২৯ এপ্রিল ২০২৪, সোমবার, ১২:৩৪:৩১ অপরাহ্ন
আবার আলোচনায় আঁতাত
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৯-০৬-২০২৩
আবার আলোচনায় আঁতাত

সরকারের অনুমতি নিয়ে এক দশক পর ১০ জুন রাজধানীতে সমাবেশ করল জামায়াতে ইসলামী। নিবন্ধন বাতিল হওয়া দলটির নেতারা সমাবেশ থেকে সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদার করার হুমকি দিলেও সেদিন থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ আড়ালে জামায়াতের সঙ্গে কোনো সমঝোতা করছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দেয়। সন্দেহ আরও জোরালো হয়েছে ডয়চে ভেলের এক টক শোতে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহেরের এক মন্তব্য প্রচারিত হওয়ার পর।


ইউটিউবে প্রচারিত টক শোতে সঞ্চালক খালেদ মুহিউদ্দীনের প্রশ্ন ছিল, ১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামী বলেছে ‘মুক্তিযোদ্ধারা দেশের শত্রু এবং দুষ্কৃতকারী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বলা হয়েছে ভারতের দালাল। এমন অবস্থানের জন্য জামায়াতে ইসলামীর আনুষ্ঠানিকভাবে, পরিষ্কার ভাষায় জাতির কাছে দুঃখ প্রকাশ উচিত কি না?’ জবাবে এ টি এম তাহের বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময়ের যে সমস্ত বক্তব্য আপনি উচ্চারণ করছেন, আমি মনে করি, এগুলো খুবই অনুচিত উচ্চারণ। এই উচ্চারণকে কোনোভাবেই বৈধতা দেওয়ার, মেনে নেওয়ার কোনো সুযোগ নাই। আমি নিজেও এ ধরনের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যারা নিউ জেনারেশনের আছি...উই আর অব বাংলাদেশ, উই আর ফর বাংলাদেশ।’


সবশেষে আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক আঁতাত করছেন কি না, জানতে চাওয়া হলে ডা. তাহের বলেন, ‘আঁতাত শব্দটা জামায়াতে ইসলামীর অভিধানে নাই। আঁতাত হয়নি, আমরা সবার সঙ্গে কাজ করেছি। বোঝাপড়া যখন যার সঙ্গে করা দরকার, সেটা আমরা করেছি। আমরা আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির সঙ্গে বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। আবার বিএনপির সঙ্গেও কাজ করেছি।’


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে সরকার বা আওয়ামী লীগের সমঝোতার সন্দেহটা অস্বাভাবিক নয়। জামায়াতের আচরণ দেখে তো মনে হচ্ছে, তারা অনেক খুশি। খুব স্বাভাবিক আচরণ করছে যেন কিছুই হয়নি।’


জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতার যে সন্দেহ দানা বাঁধছে সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ অবশ্য আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এ রকম কোনো তথ্য আমার কাছে নেই। এটা ঠিক না।’


আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরের বক্তব্যে আমরা অবাক হয়েছি। এগুলো বলার মাধ্যমে হয়তো তারা নিজেদের গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন এনে নিবন্ধনের চেষ্টাও করতে পারে।’


আঁতাতের অভিযোগ ‘ভিত্তিহীন’ বলে দাবি করেছেন জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল হালিম। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আমরা আন্দোলন করছি। সরকারের সঙ্গে আঁতাত হলে তো আমরা এই দাবি করতাম না।’


তবে জামায়াতের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রের দাবি, প্রায় দুই বছর ধরেই সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সঙ্গে তাদের কথাবার্তা চলছে। সরকার চায়, বিএনপির সঙ্গ ছাড়ুক জামায়াত। এর বিনিময়ে জামায়াতকে কিছু সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা বলেছে। জামায়াতকে আগামী নির্বাচনে নতুন কোনো প্রতীকে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ারও প্রস্তাব করা হয়েছে। যদিও আস্থাহীনতার কারণে জামায়াতের নেতারা এখনো দ্বিধান্বিত।


বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ও বিএনপি আসলে জামায়াতকে নিয়ে ক্ষমতার খেলা খেলছে। এক মন্ত্রী বলছেন, এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। আরেক মন্ত্রী বলছেন, এটা তো কোনো নিষিদ্ধ সংগঠন না। ক্ষমতায় থাকার জন্য এবং ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য সাম্প্রদায়িক, সন্ত্রাসী শক্তির ওপর ভর করে দুটি দল দেশের সর্বনাশ করছে।’


বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নূরুল আম্বিয়া বলেন, ‘জামায়াতকে সমাবেশ করতে দিয়ে তাদের সম্পর্কে সরকার পূর্ববর্তী রাজনৈতিক অবস্থান থেকে সরে এসেছে। মন্ত্রীরা একেকজন একেক রকম কথা বলেন। এগুলো খুবই অপ্রত্যাশিত।’


বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেই জাতীয় পার্টির সমাবেশের বরাদ্দ বাতিল করে জামায়াতকে সমাবেশের জন্য হল দেওয়া হয়েছে। গত ১০ বছর নানা কারণ দেখিয়ে তাদের সমাবেশ করতে দেয়নি, কিন্তু এখন নির্বাচন সামনে রেখে পুরোপুরি রাজনৈতিক সমীকরণ থেকেই এটা করতে দিয়েছে। সরকারের আদর্শিক কোনো অবস্থান নেই। তিনি আরও বলেন, বিরোধী দলগুলো যদি নির্বাচনে অংশ না নেয় তাহলে জামায়াতের জন্য একটা সুযোগ রেখে দেওয়া হলো।


সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে সরকারের কোনো যোগাযোগ হচ্ছে কি না, সে ধরনের কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য আমাদের কাছে নেই। তবে আলামতগুলো সন্দেহ করার মতো। সরকার জামায়াতের সঙ্গে আঁতাত করলে জনগণ সেটা মানবে না।’


১০ জুনের সমাবেশের পর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘বিচার করার পরে যতক্ষণ পর্যন্ত রায় না হয়, দোষী সাব্যস্ত না করা হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তো আমি বলতে পারব না যে জামায়াত দোষী।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছিলেন, সহিংসতা এড়াতে জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়।নিবন্ধন প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, এটা করতে সময় লাগে না।


এসব বিষয়ে সন্দেহ দেখা দেয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটেও। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন জাতীয় সংসদে বলেছেন, ‘সাপের মুখে চুমু খেলে ছোবল মারবে।’ মেনন পরে সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘এটি মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, এখানে একধরনের সমঝোতার চেষ্টা করা হয়েছে, যেটি অতীতেও হয়েছিল।’


নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ ভূরাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবেই জামায়াতকে সামনে এনেছে বলে মনে করেন অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে পার হওয়া এখন আওয়ামী লীগের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ভারতকে পক্ষে রাখতে চায় তারা। জামায়াতকে সামনে এনে তারা ভারতকে এই বার্তা দিতে চায় যে, তোমরা যদি আমাদের পক্ষে না থাক, তাহলে জামায়াতসহ মৌলবাদীরা শক্তিশালী হয়ে উঠবে।’  


শেয়ার করুন