উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় সারা দেশ শোকে স্তব্ধ। সেনাবাহিনীর আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, সোমবার দুপুরে বিমানবাহিনীর এফ-৭ বিজিআই প্রশিক্ষণ বিমানটি ঢাকার কুর্মিটোলার বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ঘাঁটি একে খন্দকার থেকে উড্ডয়নের পরপরই যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিধ্বস্ত হয়।
দুর্ঘটনা মোকাবিলায় ও বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে বিমানটির পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম বিমানটিকে ঘনবসতি এলাকা থেকে জনবিরল এলাকায় নিয়ে যাওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বিমানটি ঢাকার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দোতলা একটি ভবনে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত হয়েছে।
এর আগে গত এক দশকে এফ-৭ যুদ্ধবিমানের একাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। মাইলস্টোনের আজকের দুর্ঘটনায় আবারও আলোচনায় এই বিমানের কার্যক্ষমতা, যান্ত্রিক ত্রুটি ও দুর্ঘটনার বিষয়টি।
চীনের তৈরি এফ-৭ যুদ্ধবিমান এক সময় অনেক উন্নয়নশীল দেশের জন্য ছিল তুলনামূলক কম খরচে আকাশ প্রতিরক্ষার একটি সমাধান। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই ‘সাশ্রয়ী’ সমাধান আজ পরিণত হয়েছে বিপজ্জনক বোঝায়। পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া, ইরানসহ আরও কয়েকটি দেশে ব্যবহার হওয়া এই বিমানটি এখন প্রায়ই শিরোনামে আসে—বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দুর্ঘটনার কারণে।
এফ-৭ যুদ্ধবিমানের বৈশিষ্ট্য
এফ-৭ যুদ্ধবিমান তৈরি করে চীনের চেংদু এয়ারক্রাফট করপোরেশন (সিএসি)। অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের জন্য চীনে এটি জে-৭ নামে পরিচিত। তবে রপ্তানির সময় এর নামকরণ হয় এফ-৭।
জে-৭ মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নের মিগ-২১ যুদ্ধবিমানের চীনা সংস্করণ। ১৯৬০-এর দশকে সোভিয়েত প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে বিমানটি নির্মিত হয়। তবে চীনকে অসম্পূর্ণ তথ্য সরবরাহ করায় দেশটি রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে নিজস্ব সংস্করণ তৈরি করে।
১৯৬৪ সালে উৎপাদন শুরু হলেও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কারণে প্রকৃত উন্নয়ন ব্যাহত হয়। এরপর ১৯৮০ ও ’৯০ দশকে বিমানটির একাধিক উন্নত সংস্করণ তৈরি করে চীন। পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মিসর, শ্রীলঙ্কা, নাইজেরিয়া, জিম্বাবুয়ে, তানজানিয়াসহ অনেক দেশেই এটি রপ্তানি করা হয়।
বিশেষ করে পাকিস্তানের জন্য তৈরি জে-৭পি এবং জে-৭পিজি সংস্করণগুলোতে উন্নত ইতালীয় রাডার ও ইউরোপীয় ক্ষেপণাস্ত্র যুক্ত করা হয়েছিল। বাংলাদেশও বেশ কয়েক বছর ধরে এফ-৭বিজিআই সংস্করণ ব্যবহার করেছে।
বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর মোট ৩৬টি এফ-৭ যুদ্ধবিমান রয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই এফ-৭ বিজিআই ভ্যারিয়েন্ট। তবে এফ-৭ এমবি ও এফটি-৭ ভ্যারিয়েন্টও রয়েছে। তবে মোট ফাইটার ভ্যারিয়েন্ট ৩৬টি।
লাইটওয়েট মাল্টিরোল ফাইটার ধরনের এই যুদ্ধবিমানগুলোর গতি সাধারণত মাক ২ দশমিক ২ বা শব্দের গতির অন্তত ২ দশমিক ২ গুণ। এগুলোতে আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র, লেজার গাইডেড বোমা, জিপিএস গাইডেড বোমা এবং বাড়তি জ্বালানি ট্যাংক ও অস্ত্র বহনের জন্য পাঁচটি হার্ডপয়েন্ট রয়েছে। এই যুদ্ধবিমানগুলো ১ হাজার ৫০০ কেজির মতো ভার বহন করতে পারে।
এ ধরনের যুদ্ধবিমানের ককপিটে একজনমাত্র পাইলট বসতে পারেন। ককপিট সম্পূর্ণ কাচের। এফ-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমানে ব্যবহার করা হয়েছে কেএলজে-৬ এফ রাডার। এই যুদ্ধবিমান ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৭ হাজার ৫০০ মিটার বা ৫৭ হাজার ৪২০ ফুট পর্যন্ত উচ্চতায় উড়তে সক্ষম।
তবে যুদ্ধক্ষেত্রে সীমিত সক্ষমতা, আধুনিক বিমানের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারা এবং বারবার দুর্ঘটনায় পতিত হওয়ার কারণে ধীরে ধীরে এর ব্যবহার কমিয়ে আনা হয়। চীনের বিমানবাহিনী ২০২৩ সালে এই যুদ্ধবিমানের ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করে।
জে-৭ এর জায়গা দখল করেছে চীনের পরবর্তী প্রজন্মের যুদ্ধবিমান, যেমন জেএফ-১৭ থান্ডার, চেংদু জে-১০ এবং সর্বাধুনিক সেংয়াং জে-৩৫এ।
একটির পর একটি দুর্ঘটনা
গত এক দশকে এফ-৭ যুদ্ধবিমানের একাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে, বিশেষ করে প্রশিক্ষণ চলাকালীন বা রুটিন টহল অভিযানে।
২০০৮ সালের এপ্রিলে টাঙ্গাইলের ঘাটাইলের পাহাড়িপাড়া গ্রামে পাইলটসহ বিধ্বস্ত হয় একটি এফ-৭ প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান। এতে নিহত হন স্কোয়াড্রন লিডার মোর্শেদ হাসান। দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে তখন সম্ভাব্য কারিগরি ত্রুটির কথা উল্লেখ করা হয়।
২০১৫ সালের জুনে এফ-৭ এমবি ৪১৬ মডেলের একটি যুদ্ধবিমান চট্টগ্রামে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে বিধ্বস্ত হয়। নিখোঁজ হন পাইলট তাহমিদ রুম্মান। এটি বিমান বাহিনীর জহুরুল হক ঘাঁটি থেকে উড্ডয়ন করেছিল। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার কয়েক মিনিট পর যুদ্ধবিমানটি পতেঙ্গা সৈকতের প্রায় ৬ নটিক্যাল মাইল দূরে সাগরে বিধ্বস্ত হয়।
২০১৮ সালের নভেম্বরে প্রশিক্ষণের সময় টাঙ্গাইলের মধুপুরে বিধ্বস্ত হয় এফ-৭ বিজি। এতে নিহত হন পাইলট আরিফ আহমেদ। এয়ারক্রাফটটি ঢাকা থেকে উড্ডয়নের ২৫ মিনিটি পর মধুপুরের রসুলপুর এলাকায় বিধ্বস্ত হয়ে আগুন ধরে যায়।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালিতে একটি এফ-৭ প্রশিক্ষণ চলাকালে বিধ্বস্ত হয়। পাইলটরা বেঁচে ফেরেননি। তার আগেও দেশটিতে একাধিক দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়, যার বেশিরভাগই ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাওয়া কিংবা হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারানোর কারণে ঘটেছে।
২০২২ সালে ইরানে এই সিরিজের একটি বিমান বিধ্বস্ত হয়ে দুজন পাইলট মারা যান।
গত মাসে মায়ানমার বিমান বাহিনীর একটি এফ-৭এম বিমান অভিযানের সময় একটি গ্রামে বিধ্বস্ত হয়। আর সর্বশেষ বাংলাদেশের উত্তরায় মর্মান্তিক বিধ্বস্তের ঘটনাটি ঘটল।
এ ধরনের ঘটনাগুলোর পেছনে সাধারণত থাকে প্রযুক্তিগত ত্রুটি, পুরনো যন্ত্রাংশ, কিংবা জরুরি মুহূর্তে ইজেকশন সিট কাজ না করার মতো মারাত্মক সমস্যা।
আধুনিক আকাশযুদ্ধে টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় রাডার, নেভিগেশন ও অস্ত্র ব্যবস্থাপনার দিক দিয়ে এটি অনেকটাই পিছিয়ে।
বাংলাদেশ যেমন এফ-৭বিজিআই মডেল ব্যবহার করে, যা কিছু উন্নত রাডার ও ককপিট ডিজপ্লে যুক্ত, কিন্তু তা আধুনিক ৪র্থ প্রজন্মের যুদ্ধবিমানের সঙ্গে তুলনাযোগ্য নয়। এই বিমানে নেই উন্নত নেটওয়ার্কিং, বিবিআর মিসাইল সাপোর্ট, কিংবা ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেম।
ইঞ্জিন জটিলতা ও ইজেকশন ব্যর্থতা
এফ-৭-এর সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর একটি হলো এর ইঞ্জিন। সিঙ্গেল টার্বোজেট ইঞ্জিন ব্যবহারের কারণে মাঝআকাশে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেলে পাইলটের আর কিছু করার থাকে না।
অনেক সময় পাইলট ইজেক্ট করতে গেলেও দেখা যায়, ইজেকশন সিট ঠিকমতো কাজ করছে না। ফলে প্রশিক্ষণ মিশন হলেও তা হয়ে ওঠে প্রাণঘাতী।
দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে বিমানগুলোর মধ্যে ধাতব ক্লান্তি (metal fatigue), ফাটল ও স্ট্রাকচারে দুর্বলতা তৈরি হয়, যা দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়িয়েছে।
এর আগেও বাংলাদেশের বিমান বাহিনীর বহরে থাকা এ বিমানের একাধিকবার ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাওয়া, হাইড্রোলিক সিস্টেম ফেল করা কিংবা রাডার সমস্যার কারণে মাঝআকাশে সমস্যা তৈরি হয়েছে।
শুধু পাইলটদের দক্ষতার কারণেই অনেক সময় বড় দুর্ঘটনা এড়ানো গেছে। কিন্তু প্রতিবারই এর পেছনে ধরা পড়ছে এক বা একাধিক যান্ত্রিক ত্রুটি।
এই বিমানের বিদায় এখন সময়ের দাবি
আধুনিক যুদ্ধবিমানগুলো যেখানে স্টেলথ প্রযুক্তি, ডেটা লিঙ্ক, মাল্টিরোল কমব্যাট ক্যাপাবিলিটি নিয়ে প্রস্তুত, সেখানে এফ-৭ একটি দুর্বল প্রতিযোগী।
পাকিস্তান ইতোমধ্যেই এ যুদ্ধবিমানকে পর্যায়ক্রমে বাদ দিয়েছে এবং চীনের সঙ্গে যৌথভাবে তৈরি জেএফ-১৭ থান্ডার চালু করছে।
এফ-৭ এক সময় নিজের কাজটি দক্ষতার সঙ্গে করেছে। এটি নিজের সময়ে দ্রুতগামী ছিল, রক্ষণাবেক্ষণ তুলনামূলক সহজ ছিল এবং অনেক দেশের প্রথম ফ্রন্টলাইন ফাইটার হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে।
কিন্তু সময় বদলেছে। প্রযুক্তি উন্নত হয়েছে, যুদ্ধের ধরন পাল্টেছে। আজকের দিনে এ বিমানকে আকাশে রাখার মানে শুধু ব্যয় নয়, জীবন ঝুঁকির ক্ষেত্রেও বড় প্রশ্ন তৈরি করছে।
এখন সময় এসেছে সম্মানের সঙ্গে এই পুরনো আকাশযোদ্ধাকে অবসর দেওয়ার। কারণ, বারবার ফিরে আসা দুর্ঘটনার খবর শুধু হারানো জীবনের করুণ গল্পই বলে না, বলে একটি যুগের সমাপ্তির কথাও।