২৮ এপ্রিল ২০২৪, রবিবার, ০১:৩৬:১৬ পূর্বাহ্ন
জাতীয় কাউন্সিল নিয়ে ভাবছে বিএনপি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৬-০৩-২০২৪
জাতীয় কাউন্সিল নিয়ে ভাবছে বিএনপি

দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তিন বছর পরপর সম্মেলন (কাউন্সিল) করে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি নির্বাচন করার কথা বিএনপির। কিন্তু দীর্ঘ প্রায় আট বছর দলটির কাউন্সিল হচ্ছে না। সরকারবিরোধী আগামীর আন্দোলন সামনে রেখে সংগঠন পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরুর মধ্যে এবার জাতীয় কাউন্সিল নিয়ে ভাবছে দলটি। এর মধ্য দিয়ে দল ও সারা দেশের নেতাকর্মীরা চাঙা ও উজ্জীবিত হতে পারেন বলে নীতিনির্ধারকদের অনেকে মনে করছেন। সোমবার বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে এমন আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে দলের হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনো কিছু জানানো হয়নি। নীতিনির্ধারকদের আগামী বৈঠকে কাউন্সিল নিয়ে মোটামুটি সিদ্ধান্ত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ওই বৈঠকে কাউন্সিলের তারিখও নির্ধারণ করা হতে পারে।


এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্যকে ফোন করা হলেও কোনো কিছু বলতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় কাউন্সিল নিয়ে গত বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। তারিখ নির্ধারণ করা হলে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে।


গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নির্বাচিত কমিটি করার কথা বলা আছে। বিএনপির সর্বশেষ জাতীয় নির্বাহী কমিটির ষষ্ঠ কাউন্সিল হয় ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ। বিএনপির গঠনতন্ত্রে বলা আছে, জাতীয় কাউন্সিলে দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটি নির্বাচিত হবে। এ কমিটি নির্বাচিত হবে তিন বছরের জন্য। সে হিসাবে ২০২২ সালের মার্চের মধ্যে দলটির আরও দুটি কাউন্সিল হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু একটিও হয়নি। যদিও দলটির নেতাদের দাবি, সরকারের দমনপীড়নের কারণে কাউন্সিল করা যায়নি।


বিএনপির বিগত আন্দোলন ব্যর্থতায় ঘুরে দাঁড়াতে সংগঠন পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু করেছেন হাইকমান্ড। এর অংশ হিসাবে শুক্রবার জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন আংশিক কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে দলটির সংগঠন পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে দায়িত্বশীল নেতারা জানিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো।


জানা যায়, বৈঠকে আলোচনার শেষ পর্যায়ে স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য জাতীয় কাউন্সিলের প্রসঙ্গটি সামনে আনেন। তিনি বলেন, যেহেতু অনেকদিন বিএনপির কাউন্সিল হয়নি, এখন কাউন্সিল করা যেতে পারে। বিষয়টি নিয়ে আমাদের ভাবা উচিত। তবে চাইলেই তো কাউন্সিল করা যাবে না। এজন্য প্রস্তুতির ব্যাপার রয়েছে। সিদ্ধান্ত হলে বেশ কয়েক মাস সময় লাগবে। বৈঠক সূত্র জানায়, কাউন্সিল নিয়ে এমন প্রস্তাবনার পর স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য এ বিষয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন থাকায় দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বৈঠকে নেই। আগামী বৈঠকে আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। ফলে কাউন্সিলের বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।


এছাড়া বৈঠকে গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে বিক্ষোভ কর্মসূচি দেওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর আগের বৈঠকে এ ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছিল। যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের সঙ্গে আলোচনার পর যে কোনো সময় এই কর্মসূচি ঘোষণা করা হতে পারে। তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকের পর যুগপতের শরিকদের সঙ্গে এ নিয়ে এখনো কোনো আলোচনা হয়নি বলে জানা গেছে। সূত্রমতে, রমজান শুরুর আগেই এই বিক্ষোভ কর্মসূচি হতে পারে। এদিকে নেতাকর্মীদের চাঙা ও উজ্জীবিত করতে আসন্ন রমজানে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত ইফতারপূর্ব আলোচনাসভা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সাংগঠনিক জেলাগুলোর ইফতারে ভার্চুয়ালি যুক্ত হবেন। দলের সাংগঠনিক ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকরা এখন জেলা নেতাদের সঙ্গে বিষয়টি সমন্বয় করছেন। কেন্দ্রীয়ভাবে এবার চারটি ইফতার মাহফিল করা হতে পারে।


এদিকে নির্দিষ্ট সময়ে কাউন্সিল না হওয়ায় দলের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশাও দেখা গেছে। দীর্ঘদিন আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে সক্রিয় ভূমিকা পালনের পরও তারা কেন্দ্রীয় কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদ পাচ্ছেন না। নিয়মিত কাউন্সিল হলে অনেকেই নেতা হওয়ার সুযোগ পেতেন। এতে দলের নেতৃত্বেরও বিকাশ ঘটত। পদ-পদবি না পেয়ে অনেকে দলীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন। তাদের দাবি, আগামী দিনের আন্দোলনকে গতিশীল করতে কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব জরুরি। যারা বয়সের ভারে ন্যুব্জ ও নিষ্ক্রিয়, তাদের কমিটি থেকে বাদ দিতে হবে। অযোগ্য ও বিতর্কিতদের বাদ দিয়ে কমিটির আকার করতে হবে ছোট। আন্দোলন-সংগ্রামে পরীক্ষিত, যোগ্য ও ত্যাগী নেতাদের নিয়ে ঢেলে সাজাতে হবে কেন্দ্রীয় কমিটি। এজন্য ছোট পরিসরে হলেও কাউন্সিল করার তাগিদ মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের।


গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে কাউন্সিল না হওয়া প্রসঙ্গে দলের দুজন নীতিনির্ধারক যুগান্তরকে বলেন, দলের নেত্রী খালেদা জিয়া এখনো বন্দি। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশের বাইরে। শীর্ষ নেতা দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও অসুস্থ। সর্বশেষ কাউন্সিলের পর থেকে নতুন করে কাউন্সিল করার পরিবেশ-পরিস্থিতি ছিল না, এটাও বাস্তবতা। তাছাড়া করোনা মহামারিসহ রাজনৈতিক পরিবেশ নিজেদের অনুকূলে না থাকায় কাউন্সিল করা সম্ভব হয়নি। বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে হামলা-মামলা হয়েছে। গুম-খুনের শিকার হয়েছেন অনেক নেতাকর্মী। সর্বশেষ আন্দোলনের মধ্যে ২৮ অক্টোবরে ঢাকার মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর থেকেই গ্রেফতার করা হয়েছে অন্তত ২৬ হাজার নেতাকর্মীকে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগমুহূর্তে সাজা দেওয়া হয়েছে দেড় হাজারেরও বেশি নেতাকর্মীকে। যদিও অনেকে এখন কারামুক্ত। পরিস্থিতি যাই থাকুক, কাউন্সিল তো করতে হবে। যদিও জাতীয় কাউন্সিল একটা বিশাল কর্মযজ্ঞ। চার হাজারের বেশি কাউন্সিলর, এরপর রয়েছেন ডেলিগেট-এমন একটা কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়ন করাও সময়ের দরকার। তার মধ্যে আবার ৮২টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে অধিকাংশই চলছে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়ে। মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি গঠনেরও একটি বিষয় রয়েছে। গণতান্ত্রিক দল হিসাবে বিএনপির কেন্দ্রীয় কাউন্সিল করতে হবে। হয়তো শিগ্গিরই একটা তারিখ নির্ধারণ করে প্রস্তুতি শুরু করা হবে।


সর্বশেষ ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের কিছুদিন পর স্থায়ী ও নির্বাহী কমিটি ঘোষণা করা হয়। ৫০২ সদস্যের নির্বাহী কমিটি ঘোষণা করা হলেও বেশ কয়েকটি পদ ফাঁকা ছিল। এছাড়া স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যানসহ নির্বাহী কমিটির বেশ কয়েকজন নেতা মারা গেছেন। কেউ কেউ পদত্যাগও করেছেন। কাউকে আবার বহিষ্কারও করা হয়েছে। পদোন্নতি দিয়ে কয়েকটি পদ পূরণ করা হলেও অনেক পদ এখনো ফাঁকা। ১৯ সদস্যের স্থায়ী কমিটির শুরুতেই দুটি পদ ফাঁকা ছিল। এরপর তরিকুল ইসলাম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ, এমকে আনোয়ার ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ মারা যান। এছাড়া রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান। যদিও তার পদত্যাগপত্র বিএনপির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান কোনোটিই করা হয়নি। অসুস্থ থাকায় ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া স্থায়ী কমিটির বৈঠকসহ কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছেন না। এর মধ্যে ২০১৯ সালের জুনে বেগম সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে স্থায়ী কমিটির শূন্যপদে নিয়োগ দেওয়া হয়। সেই হিসাবে এখন সদস্যসংখ্যা ১৪ জন। পাঁচটি পদ শূন্য রয়েছে। ৩৭ জন ভাইস চেয়ারম্যানের মধ্যে অন্তত ৯টি পদই ফাঁকা। এছাড়া ৭৩ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটির মধ্যেও বেশ কয়েকজন মারা গেছেন। নির্বাহী কমিটির সদস্যদের মধ্যেও কয়েকজন মারা গেছেন। কয়েকজনকে বহিষ্কার আর কয়েকজন স্বেচ্ছায়ও পদত্যাগ করেছেন। সব মিলিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির ১৩০টির মতো পদ এখন শূন্য। তাছাড়া বয়সের কারণেও বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিষ্ক্রিয়।


দলটির নেতারা জানান, এর আগেও সারা দেশের সাংগঠনিক জেলা কমিটি পুনর্গঠন করে কেন্দ্রীয় কাউন্সিল করতে কয়েকবার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সর্বশেষ ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তৃণমূলের কমিটি পুনর্গঠনের ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয়। বেশ কয়েকটি জেলার আহ্বায়ক কমিটিও ঘোষণা করা হয়। কিন্তু করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় থমকে যায় পুনর্গঠন, সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড স্থগিত রাখা হয়। পরে আবারও পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু সেসব কমিটির মেয়াদও ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে।

শেয়ার করুন