০২ মে ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ০১:৩১:১৭ অপরাহ্ন
সংকট নেই, চক্রের ফাঁদে পেঁয়াজ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১১-১২-২০২৩
সংকট নেই, চক্রের ফাঁদে পেঁয়াজ

দেশে উৎপাদিত ও আমদানিকৃত পেঁয়াজের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও পেঁয়াজ রপ্তানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞা আরোপের খবরে মাত্র একদিনের ব্যবধানে দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে এ নিত্যপণ্যটির। কার্যত, রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার অজুহাতে চলছে অসাধু ব্যবসায়ীদের লুটের মচ্ছব। পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা তৈরি করে ভোক্তার পকেট থেকে দৈনিক ১০৭ কোটি টাকারও বেশি লুট হয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেনÑ এটি ব্যবসা নয়, স্রেফ ডাকাতি।


বাজার যাচাই-বাছাই করে সরকার


খুচরা পর্যায়ে প্রতিকেজি পেঁয়াজের দাম ৬৫ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু বর্তমানে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২২০ টাকায়, আমদানি পেঁয়াজ ১৯০ টাকায়। অর্থাৎ দেশি ও আমদানি মিলিয়ে এক কেজি পেঁয়াজের পেছনে সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের তিন গুণ গুনতে হচ্ছে ভোক্তাদের। প্রসঙ্গত, গত ১৪ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ডিম, আলুর পাশাপাশি পেঁয়াজের দামও খুচরা পর্যায়ে ৬৪ থেকে ৬৫ টাকা কেজি নির্ধারণ করে দেন।


ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার সে দেশে পেঁয়াজের সরবরাহ ও দাম স্বাভাবিক রাখতে পণ্যটি রপ্তানির ওপর আগামী মার্চ মাস পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। গত শুক্রবার ভারতের ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফরেন ট্রেডের এ নিষেধাজ্ঞার খবর প্রকাশের একদিনের মধ্যে বাংলাদেশে পেঁয়াজের দাম ১২০-১৩০ টাকা থেকে বেড়ে ২২০ টাকায় পৌঁছায়। অন্যদিকে আমদানি করা পেঁয়াজের কেজি ২০০ টাকা ছুঁইছুঁই করছে। একদিনের ব্যবধানে এমন অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে আলোচনায় উঠে এসেছে পেঁয়াজ।


পেঁয়াজের দামে আচমকা এমন উল্লম্ফনের পর রোববার দিনভর পেঁয়াজের বাজারে অভিযান চালাচ্ছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। গত শনিবার ১৩৩ প্রতিষ্ঠানকে ৬ লাখ ৬৬ হাজার টাকা এবং গতকাল ৮০টি প্রতিষ্ঠানকে ৩ লাখ ৭০ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করেছে অধিদপ্তর। কিন্তু এরপরও নিয়ন্ত্রণে আসছে না বাজার। আকাশচুম্বী সে দামেই স্থির রয়েছে দেশি ও আমদানি করা পেঁয়াজ। নিত্যপ্রয়োজনীয় এ ভোগ্যপণ্যটির এমন অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিকে ‘ডাকাতি’ বলে মনে করেন ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন। তিনি বলেন, পেঁয়াজে যেটা হচ্ছে, সেটাকে ব্যবসা বলা যাবে না। ভোক্তাকে জিম্মি করে ‘ডাকাতি’ চলছে। ব্যবসার ক্ষেত্রে দেশে সুশাসনের প্রচ- রকম ঘাটতি রয়েছে। যার সুযোগ নিয়ে একের পর এক পণ্য নিয়ে কারসাজি চলছে।


তিনি আরও বলেন, আমাদের পেঁয়াজের উৎপাদন বেড়েছে। পুরনো পেঁয়াজ এখনো পাওয়া যাচ্ছে, নতুন পেঁয়াজ আসছে। তাছাড়া বাজারে যে পেঁয়াজ রয়েছে সেগুলো আগের দামে কেনা। অথচ ভারতের এক ঘোষণায় আবারো মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে সিন্ডিকেট চক্র। আবারো তারা অস্থিরতা সৃষ্টি করে অল্পদিনের মধ্যে বিপুল অনৈতিক মুনাফা হাতিয়ে নেওয়ার ফন্দি করছে।


পেঁয়াজের চাহিদা ও বাজারমূল্য পর্যালোচনা করে পেঁয়াজে একদিনের অতিরিক্ত মুনাফার একটি ধারণা পাওয়া যেতে পারে। দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ২৬ থেকে ২৮ লাখ মে. টন। অর্থাৎ দৈনিক চাহিদা ৭ হাজার ৬৭১ দশমিক ২৩ মে. টন। কেজি হিসাবে দৈনিক পেঁয়াজের চাহিদা দাঁড়ায় ৭৬ লাখ ৭১ হাজার ২৩০ কেজি। ধারণামূলক হিসাবে, এই পরিমাণ পেঁয়াজের প্রতিকেজিতে (দেশি ও আমদানিকৃত পেঁয়াজ মিলিয়ে) গড়ে ১৪০ টাকা অতিরিক্ত মুনাফা করলে দৈনিক মোট মুনাফা দাঁড়ায় ১০৭ কোটি ৩৯ লাখ ৭২ হাজার ২০০ টাকা। অর্থাৎ কৃত্রিম সংকটের অজুহাতে পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা তৈরি করে ভোক্তার পকেট থেকে দৈনিক ১০৭ কোটি টাকারও বেশি হাতিয়ে নিচ্ছে সিন্ডিকেট চক্র।


ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ মজুদকালে নষ্ট হয়ে যায়। ফলে ঘাটতি থেকে যায়। এ ঘাটতি পূরণ হয় আমদানি করা পেঁয়াজে। এক্ষেত্রে আমদানির বড় একটি অংশ আসে পাশের দেশ ভারত থেকে। ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন, গত শুক্রবার ভারত পেঁয়াজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় দেশের বাজারে সংকট দেখা দিয়েছে। তারা বলছেন, বাজারে দেশি পেঁয়াজ ফুরিয়ে এসেছে। নতুন পেঁয়াজ উঠলেও তা চাহিদার তুলনায় কম। ফলে দাম বেড়ে গেছে।


পেঁয়াজ পাইকার সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল মাজেদ বলেন, ভারতের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞায় দেশের বাজারে বড় প্রভাব পড়েছে। তাছাড়া গত কয়েক দিনের বৃষ্টির প্রভাবও রয়েছে। তবে কেউ কেউ আরও বেশি দাম বাড়িয়েছে।


এদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, প্রতিবছর পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়ছে। দেশে পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে ২৬ থেকে ২৮ লাখ মে. টন। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন ছিল ৩৪ দশমিক ৬০ লাখ মে. টন। মজুদকালে নষ্ট হওয়া ৩০ শতাংশ পেঁয়াজ বাদ দিয়েও তা দাঁড়ায় ২৪ দশমিক ২২ লাখ মে. টন। এ সময় আমদানি অনুমতি দেওয়া হয় ২৪ দশমিক ৮৩ লাখ মে. টন এবং আমদানি হয় ৭ দশমিক ৪৩ লাখ মে. টন। অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশি ও আমদানিকৃত মিলিয়ে দেশে পেঁয়াজের প্রাপ্যতা ছিল ৩১ দশমিক ৬৫ লাখ মে. টন। অর্থাৎ চাহিদার চেয়ে ৩ দশমিক ৬৫ লাখ মে. টন বেশি ছিল। শুধু তাই নয়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আবাদ বেড়েছে। তাই এবার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৬ দশমিক ৭৩ লাখ মে. টন। নতুন পেঁয়াজ এরই মধ্যে বাজারে উঠছে।


কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যও বলছে, প্রতি বছর মুড়িকাটা পেঁয়াজ আবাদ হয় প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে এবং উৎপাদন হয় প্রায় ৮ লাখ মে. টন। এছাড়া এ বছর গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ আবাদ হয়েছে আরও প্রায় ৫০০ হেক্টর জমিতে। এখান থেকে উৎপাদন হবে প্রায় ৫০ হাজার মে. টন। এই মুড়িকাটা ও গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ বাজারে আসা শুরু হয়েছে এবং বাজারে থাকবে আগামী তিন থেকে সাড়ে তিন মাস। এর পর মূল পেঁয়াজ আসা শুরু হবে।


জানা গেছে, গত শনিবার চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ স্থলবন্দর দিয়ে ২৬টি ট্রাকে করে ৭৪৩ টন ভারতীয় পেঁয়াজ দেশে ঢুকেছে। আরও বেশকিছু ট্রাক বন্দরে প্রবেশের অপেক্ষায় আছে। একই দিন সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে ২০টি ট্রাকে প্রায় ৬০০ মে. টন পেঁয়াজ এসেছে। অর্থাৎ ভারত রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলেও এখনই বাজারে এত দাম বাড়ার কথা নয়।


বারবার পেঁয়াজের বাজারে বড় ধরনের অস্থিরতা দেখা দিলেও কার্যকর পদক্ষেপ বা প্রস্তুতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না উল্লেখ করে ক্যাবের সহ-সভাপতি নাজের হোসাইন বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেপ্টেম্বর-নভেম্বরের সময় পেঁয়াজের বাজার অস্থির হয়ে উঠছে। তাছাড়া ভারত থেকে রপ্তানিমূল্য বৃদ্ধি বা হুটহাট রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেলে দেশের বাজার রাতারাতি উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। অথচ আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে, বিশেষ করে কৃষি মন্ত্রণালয়ের আগাম কোনো কর্মপরিকল্পনা দেখতে পাচ্ছি না। আমাদের কখন কতটা ঘাটতি রয়েছে, কতটুকু কোন উৎস দেশ থেকে আমদানি করতে হবেÑ সে ধরনের কোনো প্রস্তুতিই নেই।


বাজার নিয়ন্ত্রণে মাঠে গোয়েন্দা পুলিশ


বাজারে চড়া দামে পেঁয়াজ বিক্রি এবং সে সঙ্গে এ পণ্যটি মজুদ ও কালোবাজারি করা হলে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুশিয়ারি দিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ। ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) হারুন অর রশীদ বলেছেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক দল চকবাজার ও শ্যামবাজার এলাকায় কাজ করছে।


গতকাল রাজধানীর মিন্টু রোডের নিজ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কেউ যদি কালোবাজারি করে, পেঁয়াজ মজুদ করে এবং বেশি দামে বিক্রির পাঁয়তারা করে, তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসব। ডিবির লালবাগ বিভাগের একাধিক টিম চকবাজার ও শ্যামবাজার এলাকায় কাজ করছে। গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করছে।


চলছে অভিযান, জরিমানা


পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণে জেলাপর্যায়ে অভিযান চালাচ্ছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। গত শনিবার প্রথম দিনের অভিযানে ১৩৩ প্রতিষ্ঠানকে ৬ লাখ ৬৬ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। গতকালের অভিযানে ৮০টি প্রতিষ্ঠানকে ৩ লাখ ৭০ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করেছে অধিদপ্তর।


অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, পেঁয়াজের মূল্য স্থিতিশীল ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে ঢাকা মহানগরসহ দেশের সব বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে ভোক্তা অধিদপ্তরের বাজার অভিযান পরিচালনা করা হয়। এর মধ্যে রাজধানীতে অধিদপ্তরের ৪টি টিম অভিযান চালায়। পাশাপাশি অন্যান্য বিভাগীয় শহরসহ দেশের মোট ৪০টি জেলায় একযোগে এ অভিযান পরিচালিত হয়। এ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে বলে জানায় অধিদপ্তর।


শেয়ার করুন