রাজশাহী বাগমারা উপজেলার তাহেরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের সময় শিক্ষক আব্দুস সালামের ওপর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে। গুরুতর আহত অবস্থায় ওই শিক্ষককে উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) দুপুর একটার দিকে তাহেরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এই ঘটনা ঘটে। ঘটনার পর পুরো স্কুলজুড়ে শিক্ষক শিক্ষার্থী অভিভাবকদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় শিক্ষার্থীরা ভয়ে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করেন। পরবর্তীতে পুলিশে খবর দিলে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, তাহেরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বেলা ১১ টার দিকে প্রধান শিক্ষক (চলতি দায়িত্ব) সৈয়দ জুবায়ের মো. কিবরিয়ার, বিভিন্ন অনিয়ম, রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার, গাইড বাণিজ্য, আধিপত্য, দুর্নীতিসহ ধারাবাহিক নিউজ প্রচার হয় গণমাধ্যমে। এ নিয়ে বেশ নড়েচড়ে বসে জেলা ও উপজেলা শিক্ষা অফিস।
এ ছাড়া একই স্কুলের সহকারী শিক্ষক শহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের বিষয়ে উপজেলা শিক্ষা অফিসে একটি অভিযোগ দেন এক অভিভাবক। ফলে সেটিরও তদন্তে আসেন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা।
এদিন সকাল থেকে দুই শিক্ষকের অভিযোগের বিষয় জানতে স্কুলে প্রাঙ্গণে জড়ো করা হয় অভিভাবকদের। পাশাপাশি আধিপত্য বিস্তার করতে সকাল থেকে অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক সৈয়দ জুবায়ের মো. কিবরিয়া ৩০-৪০ জন অভিভাবক ছাড়া বহিরাগতদের সমাগম ঘটায় এবং তার ঘনিষ্ঠ অধিকাংশ অভিভাবকদের সভায় উপস্থিত নিশ্চিত করেন। পরবর্তীতে শিক্ষা অফিসারের পক্ষ থেকে অভিযুক্ত শিক্ষকদের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় অভিভাবকদের কাছে। এ সময় অভিভাবকরা তাদের নিজস্ব মতামত প্রদান করেন।
পরবর্তীতে ১২টায় উন্মুক্তভাবে স্কুল প্রাঙ্গণে সবার উপস্থিতি আবারও ওই শিক্ষকদের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় অভিভাবকদের কাছ থেকে। তখন অন্য সহকারী শিক্ষকরা নিজ নিজ ক্লাসে পাঠদান করছিলেন। ওই সময় সভা শেষে জামলয় এলাকার শহিদুলসহ চারজন অজ্ঞাত ব্যক্তি, অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক জুবায়ের মো. কিবরিয়ার সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ আলাপচারিতা করেন। তার কিছুক্ষণ পরে শহিদুল ইসলামসহ অজ্ঞাত ব্যক্তিরা সহকারী শিক্ষক আব্দুস সালামকে পুরো স্কুলে খোঁজাখুঁজি শুরু করে। তবে এদিন সভার কারণে পঞ্চম শ্রেণির বেলি শাখা এবং শিউলি শাখার গণিত ক্লাস একসাথে চলছিল, পাঠদানে দায়িত্বে ছিলেন সহকারী শিক্ষক রেজাউল করিম ও আব্দুস সালামের। শহিদুলসহ অজ্ঞাত ব্যক্তিরা খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করে সহকারী শিক্ষক রেজাউল করিমের উপস্থিতিতে হামলা চালায়। সে সময় কিছুটা দূরে হামালার স্ব চক্ষে দেখছিলেন অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক কিবরিয়াও।
অজ্ঞাত ব্যক্তিরা শ্রেণিকক্ষে ওই শিক্ষককে প্রায় ১০ থেকে ১৫ মিনিট পেটানোর পর গুরুতর আহত করে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। পরে শিক্ষার্থীদের চেঁচামেচি ও কান্নাকাটিতে অন্যান্য শিক্ষকরা ছুটে এসে আব্দুস সালামকে উদ্ধার করে তাহেরপুর ক্লিনিকে প্রথমে নিয়ে যায়। পরে সেখানে তার শারীরিক অবস্থা অবনতি হলে টেম্পু গাড়িতে নেওয়া হয় বাগমারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। পরবর্তীতে শারীরিক অবস্থা আরও অবনতি হলে ভর্তি করা হয় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ।
এই খবর ছড়িয়ে পড়লে তাহেরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশেপাশে উত্তেজনা ও ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লে দুই উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসার আল মামুন ও শহিদুল ইসলামের নির্দেশে তড়িঘড়ি করে দুপুর তিনটার দিকে স্কুলকে ছুটি ঘোষণা করেন প্রধান শিক্ষক কিবরিয়া।
এ ঘটনায় সহকারী শিক্ষক আহত আব্দুস সালামের ছেলে তাহসীনুর জীম জানান, প্রধান শিক্ষক কিবরিয়ার বিরুদ্ধে ধারাবাহিক সত্য নিউজ প্রচার হওয়ার কারণে, উনি বারবার বাবাকে বলেছিলেন তদন্তে অফিসাররা আসলে তারপক্ষে যেন সবকিছু বলা হয় বা লেখা হয়। কোন একসময় শিক্ষা অফিসারদের কাছে কিবরিয়া স্যারের অনিয়মগুলো অন্য শিক্ষারা লিখে তিনিও লেখেন। সেটির জেরে অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক কিবরিয়া প্রতিশোধ নিতে নিজস্ব লোকজন দিয়ে বাবাকে পেটানো হয়। বর্তমানে তার শারীরিক অবস্থা ভালো না, বেশ কয়েকবার সে অচেতন হয়ে পড়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক সহকারী শিক্ষক জানান, আরটিভি অনলাইনের দ্বিতীয় অনুসন্ধানী সংবাদ প্রচারের পর থেকে অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক কিবরিয়া তিনি সহকারী শিক্ষক, আব্দুস সালাম, শহিদুল ইসলাম, নাদিরা আকতার, বানু, শিল্পর রাণী, মুক্তি রাণী, রেজিনা পারভীনকে তথ্য পাচারকারী মনগড়া হিসেবে বিবেচনা করে সন্ত্রাসীদের দিয়ে মারধর করানোর হুমকি দিয়ে আসছিলেন। সর্বশেষ অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক তিনি আজকে শ্রেণিকক্ষে তার ইন্ধনে সন্ত্রাসী হামলা চালালেন।
তারা আরও বলেন, এ ঘটনার পর থেকে শিক্ষকরা শ্রেণি পাঠদানে চরম অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। ফলে রোববার থেকে শ্রেণিকক্ষে ফেরা অনিশ্চিত বলে জানান একাধিক শিক্ষক।
অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক সৈয়দ জুবায়ের মো. কিবরিয়া সাংবাদিকদের জানান, এই ঘটনায় তার কোন ধরনের সম্পৃক্ততা নাই বলে জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে রাজশাহী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার এ কে এম আনোয়ার হোসেন বলেন, ইতোমধ্যে ওই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারকে বলা হয়েছে। এই ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
আর তাহেরপুর পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র আইসি সোহাইল জানান, বর্তমানে আমি ছুটিতে রয়েছি, তবে আমার এক অফিসার জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে জানা গেছে কারও ইন্ধনে জামলয় এলাকার শহিদুল ইসলামসহ অজ্ঞাত কয়েক ব্যক্তি সহকারী শিক্ষক আব্দুস সালামের ওপর হামলা চালিয়েছে। পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।