২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ১২:৪৪:৫৩ অপরাহ্ন
খেলাপি গ্রাহক হয়েও এনআরবিসি ব্যাংকের পরিচালক তিনি
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৬-১১-২০২৩
খেলাপি গ্রাহক হয়েও এনআরবিসি ব্যাংকের পরিচালক তিনি

নাম আবু বকর চৌধুরী। বেসরকারি এনআরবি কমার্শিয়াল (এনআরবিসি) ব্যাংকের পর্ষদ পরিচালক তিনি। একই সঙ্গে আরেক বেসরকারি ব্যাংক সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের (এসবিএসি) খেলাপি গ্রাহকও এই ব্যক্তি। এসবিএসি ব্যাংকের ৮৭ কোটি টাকার ঋণের খেলাপি হয়েও ধরে রেখেছেন এনআরবিসির পরিচালকের পদ। যদিও ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী কোনো ঋণখেলাপির ব্যাংক পরিচালক হওয়ার সুযোগ নেই।


বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, কারসাজির মাধ্যমে ২৭৫ কোটি টাকার খেলাপি ঋণকে নিয়মিত ঋণ হিসাবে দেখিয়ে আসছে সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক। খেলাপি হয়ে পড়া এসব ঋণের অন্তত ৮৭ কোটি টাকা বায়েজিদ গ্রুপের প্রতিষ্ঠান সিএসএস করপোরেশন (বিডি) লিমিডেটের স্বত্বাধিকারী আবু বকর চৌধুরীর নামে। তাঁকে তিন দফায় এই ঋণ দিয়েছে ব্যাংকটি। এর মধ্যে সিএসএস করপোরেশনের অনুকূলে এসওডি (নিরাপদ ও চলমান ঋণ সুবিধা) হিসেবে ৪০ কোটি টাকা ঋণ দেয় এসবিএসি ব্যাংকের চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ শাখা। সেই ঋণের কিস্তি অনিয়মিত হওয়ায় সুদসহ মোট খেলাপির পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৫ কোটি ১৮ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি একই ব্যাংক থেকে ২৫ কোটি ৮৪ লাখ এবং এবং ১৫ কোটি ৬৮ লাখ টাকা মেয়াদি ঋণও নেয়। কিস্তি পরিশোধ না করায় এসব ঋণও খেলাপিতে পরিণত হয়। ফলে সব মিলিয়ে এসবিএসিতে আবু বকর চৌধুরীর খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৮৭ কোটি টাকা।


খেলাপি হয়েও ব্যাংকের পরিচালক থাকছেন কীভাবে, জানতে চাইলে আবু বকর চৌধুরী বলেন, ‘ঋণখেলাপির বিষয়ে হঠাৎ করে বিস্তারিত বলা সম্ভব না। এটা কোম্পানির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভালো জানার কথা। আপনিও চাইলে বিস্তারিত খোঁজ নিতে পারেন। আর খেলাপি হয়েও একজন ঋণগ্রহীতা ব্যাংকের পরিচালক পদে বহাল থাকার বিষয়টা বাংলাদেশ ব্যাংকের ইস্যু। এ নিয়ে বেশি কিছু বলার নেই।’


এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ব্যাংক পরিচালনার জন্য সুনির্দিষ্ট আইন রয়েছে। সেই আইনে বলা আছে, কোনো খেলাপি ব্যক্তি ব্যাংকের পরিচালক থাকতে পারেন না। যদি কোনো ব্যাংকের পরিচালকের বিরুদ্ধে খেলাপির প্রমাণ পাওয়া যায়, তবে তাঁকে বরখাস্ত করা হবে। কেননা, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়।’


খেলাপিকে নিয়মিত ঋণ দেখাচ্ছে এসবিএসি মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণের কারণে মাত্র এক দশকেই চরম সমালোচনার জন্ম দিয়েছে এসবিএসি ব্যাংক। অর্থ পাচার ও সম্পদ আত্মসাতের নানান ঘটনায় বিতর্কিত হওয়ার পর এবার কারসাজির মাধ্যমে ২৭৫ কোটি টাকার খেলাপি ঋণকে নিয়মিত হিসাবে দেখিয়েছে ব্যাংকটি। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে তাদের এ কারসাজি ধরা পড়ে যায় শেষ পর্যন্ত।


এ বিষয়ে এসবিএসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাবিবুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর এত বেশি খেলাপি ঋণ গোপন করা হয়েছে, এমন তথ্য আমার জানা নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে যদি খেলাপি ঋণ গোপনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকে, তাহলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। এর বাইরে বলার কিছু নেই।’


কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, হাবিব স্টিলস লিমিটেডকে দেওয়া ১২৫ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে বকেয়া কিস্তির তথ্য গোপন করেছে এসবিএসি। কিস্তি বকেয়ার পরেও ওই ঋণ কৌশলে নিয়মিত দেখিয়ে আসছিল ব্যাংক কর্তৃপক্ষ, যা ব্যাংকিং নীতিমালার সরাসরি লঙ্ঘন।


এসবিএসি ব্যাংক থেকে মেসার্স ইস্টার্ন করপোরেশনের নেওয়া ৮৯ কোটি ৯২ লাখ টাকার ঋণ পুনঃ তফসিল নিয়ে গুরুতর অনিয়ম পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পুনঃ তফসিল প্রস্তাবনা অমান্য করে পর্যাপ্ত জামানত ছাড়াই এই ঋণের মেয়াদ বাড়ায় এসবিএসির প্রধান শাখা।


খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মেসার্স ইস্টার্ন করপোরেশন একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠান। তবে নিউ ইস্টার্ন করপোরেশন নামে একটি কোম্পানি রয়েছে, যার ঠিকানা হিসাবে ১৬৩/এ মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা, বাংলাদেশ উল্লেখ করা রয়েছে। সেখানে গিয়ে এসব ঋণের বিষয় জানতে চাইলে উপস্থিত কর্মকর্তারা এটি উড়ো খবর বলে দাবি করেন।আরেক গ্রাহক এমআরএফ ফিশারিজের মন্দমানের ৩৭ কোটি ৯২ লাখ টাকার খেলাপি ঋণও নিয়মিত দেখাচ্ছে এসবিএসি, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শনে উঠে এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী এই ঋণের ১১টি কিস্তি বকেয়া রয়েছে। তবুও ঋণ নিয়মিত দেখাচ্ছে ব্যাংক।


একই প্রতিবেদন বলছে, সাউথ বাংলা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ২০১৯ সালে মেসার্স ইইএসএম করপোরেশনকে ১ বছর মেয়াদি ওভার ড্রাফট (ওডি) ১০ কোটি টাকা ঋণ দেয়। সীমাতিরিক্ত ঋণ স্থিতি ও নবায়ন ব্যতিরেকে ঋণের মেয়াদ বৃদ্ধি করায় বাংলাদেশ ব্যাংক আপত্তি দেয়। একটা পর্যায়ে ঋণে মোট পাওনা ১২ কোটি ২২ লাখ টাকার খেলাপি ঋণে পরিণত হয়।


এ ছাড়া কবির সিকিউরিটিজ লিমিটেড ২০২২ সালে সাউথ বাংলা ব্যাংক থেকে ২৮ দিন মেয়াদে ১০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা পরে মেয়াদি ঋণে রূপান্তর করে। আর ঋণের বিপরীত কিস্তি বকেয়া ছিল। কিন্তু গ্রাহক ঋণের বিপরীতে ডাউন পেমেন্ট বকেয়া রাখে। এতে ঋণ পুনঃ তফসিলের সুযোগ গত মার্চে স্থগিত হয়ে পড়ে। এই খেলাপি ঋণ নিয়মিত দেখাচ্ছে ব্যাংকটি।


এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘কোনো ব্যাংকের খেলাপি তথ্য গোপন করা উচিত না। এটা আত্মঘাতী কাজ। আর ব্যাংকের খেলাপি যে পরিচালক হতে পারবেন না, তা ব্যাংক কোম্পানি আইনে উল্লেখ রয়েছে। খেলাপির কোনো ব্যাংকে পরিচালক পদে থাকার সুযোগ নেই। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর হস্তক্ষেপ দরকার।’


শেয়ার করুন