০৪ মে ২০২৪, শনিবার, ১১:০১:১০ পূর্বাহ্ন
প্রভাবশালী হলেও ছাড় নয় ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৬-১১-২০২৩
প্রভাবশালী হলেও ছাড় নয় ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি যতই প্রভাবশালী হোক না কেন, তিনি এবং তার গ্রুপভুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠান ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা পাবে না। পাশাপাশি জালিয়াতির মাধ্যমে নেওয়া কোনো ঋণ পুনঃতফশিলীকরণ হবে না।


প্রত্যাশা ব্যক্ত করে তিনি আরও জানান, ডিসেম্বরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি আট শতাংশের নিচে নেমে আসবে। যুগান্তরের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় তিনি বিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দা এবং বাংলাদেশে এর প্রভাব, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট, খেলাপি ঋণের অস্বাভাবিক উল্লম্ফনসহ অর্থনীতির নানা বিষয় এবং সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ নিয়ে খোলামেলা আলাপ করেন।


যুগান্তর : এ মুহূর্তে দেশের অর্থনীতি সংকটকাল অতিক্রম করছে। এর থেকে কবে নাগাদ বের হওয়া যাবে?


আ হ ম মুস্তফা কামাল : দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সংকটময় সময় পার করছে-এমনটি ভাবার কোনো যৌক্তিক অর্থনৈতিক কারণ দেখছি না। সাম্প্রতিক সময়ের দু-একটি সমস্যার কথা বাদ দিলে সার্বিকভাবে অর্থনীতি ধারাবাহিকভাবে একটি দৃঢ় অবস্থান বজায় রেখে চলেছে।


হ্যাঁ, কোভিড-১৯ অতিমারির অভিঘাত খুব সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করেছি। প্রায় সব দেশেরই উৎপাদন কমে জিডিপিতে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়। কঠিন ওই সময়ে কিছুটা ভালো অবস্থা বজায় রাখতে পেরেছে বাংলাদেশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরেও জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে বিশ্বের মধ্যে আমাদের অবস্থান ছিল পঞ্চম।


কোভিড-১৯ শুরুর আগের অর্থবছরে (২০১৮-১৯) প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৯ শতাংশ এবং কোভিড-১৯ চলমান অবস্থায়ই (২০২০-২১) প্রবৃদ্ধি হয় ৬ দশমিক ৯ শতাংশ, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে বেড়ে ৭.১ শতাংশ হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং তার দেওয়া নীতির ধারাবাহিকতা অনুসরণ করেই করোনা-পরবর্তী অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সফল হয়েছি। এর মূলে ছিল দেশের আপামর জনগণ। যে কোনো সংকটে বাংলাদেশের মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর সহজাত সক্ষমতা এবং তাদের সহনশীলতা অর্থনীতির মূল শক্তি হিসাবে কাজ করেছে।


এ মুহূর্তে মূল্যস্ফীতি কিছুটা বাড়তির দিকে থাকলেও আমরা সবাইকে সঙ্গে নিয়ে একইভাবে ঘুরে দাঁড়াব, ইনশাআল্লাহ। আমি আশাবাদী, করোনার পর যেভাবে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ঘুরে দাঁড়িয়েছিল, চলতি অর্থবছরেই লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে আগের গতিপথে ফিরে আসব।


যুগান্তর: বিশ্বের অনেক দেশে মুদ্রাস্ফীতি কমছে; কিন্তু বাংলাদেশে বাড়ছে। এটি কেন হচ্ছে?


আ হ ম মুস্তফা কামাল : দেশীয় প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতার কারণে মূল্যস্ফীতির প্রবণতা দেশভেদে পৃথক হতে পারে। ফলে সরলীকরণ করা ঠিক হবে না। আমি দায়িত্ব গ্রহণকালে মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৩ শতাংশ। সে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত কমবেশি ৬ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়।


২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্য, সারসহ অনেক পণ্যের দাম দ্রুত বাড়তে থাকে। ২০২০ সালে করোনার মধ্যে বিশ্বের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পরিমাপক বিশ্বব্যাংকের পণ্যমূল্য ইনডেক্স ছিল ৬৩ দশকি ১। মাত্র দুই বছরে যুদ্ধের পর ১২৭ শতাংশ বেড়ে ২০২২ সালে ১৪৩ দশমিক ৩ শতাংশে দাঁড়ায়। বিশ্বে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মধ্যেও ২০২১ সালে ৫ দশমিক ৬ এবং ২০২২ সালে ৬ দশমিক ১ শতাংশ মূল্যস্ফীতি ধরে রাখতে পেরেছিলাম। সেসময় কিন্তু অন্য সব দেশেরই মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়ে গিয়েছিল।


সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য কমেছে, এটাও ঠিক। আমাদের নেওয়া ফিসক্যাল ও মনিটরি পলিসির সুফল শিগগিরই পাওয়া যাবে। এর সপক্ষে আইএমএফ বলছে এবং আমরাও বিশ্বাস করি যে, মূল্যস্ফীতি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ৮ শতাংশের নিচে নেমে আসবে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সেপ্টেম্বরের ‘এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক’-এ চলতি অর্থবছর (২০২৩-২৪) শেষে দেশে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি হবে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ।


যুগান্তর : উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির জন্য ভুল পলিসি এবং বাজার ব্যবস্থাপনা ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদরা। আপনি কী বলবেন?


আ হ ম মুস্তফা কামাল : আমরা নৈর্ব্যক্তিকভাবে মূল্যস্ফীতির বর্তমান প্রবণতাকে বিশ্লেষণ করছি। করোনার সময় সুদের হার কিংবা মুদ্রা বিনিময় হারের পূববর্তী ব্যবস্থাপনা আমাদের জন্য সময়োপযোগী ছিল। সেটি সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার পক্ষে সহায়ক ছিল। অনেক কষ্ট করে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে ঋণের সুদহার এক অঙ্কের ঘরে নামিয়ে এনেছিলাম। এটি ছিল জনগণের প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি। যার ইতিবাচক ফল করোনার সময় দেখেছি।


দেশের মানুষকে এই স্বস্তি না দিতে পারলে অনেক ছোট ছোট ব্যবসায়ী পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যেতেন। লাখ লাখ শ্রমিক কর্মসংস্থান হারাতেন। সুদের হার ৯ শতাংশ বেঁধে দেওয়ায় ঋণের গড় সুদের হার ৭ দশমিক ৩ শতাংশে নেমেছিল। ইন্টারেস্ট স্প্রেডও তিন শতাংশের নিচে ছিল। এসবই করা হয়েছিল অর্থনীতির প্রধানতম চালিকাশক্তি, এসএমই, ক্ষুদ্র ও মাইক্রো এন্টারপ্রাইজগুলোকে রক্ষার লক্ষ্যে। তাদের হাত ধরেই দেশের অর্থনীতি করোনা মোকাবিলা করে সফলভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছিল।


আমি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই যে, সুদের হার নির্ধারণ করার পলিসি সেসময় যথার্থ ও কার্যকর ছিল। এ মুহূর্তে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন, সে কারণে সুদের হারকে কিছুটা বাজারনির্ভর করা হয়েছে। তবে সুদের হারকে অস্বাভাবিক হারে বাড়তে দিলে দেশের বিনিয়োগ কমে যেতে পারে। দেশীয় মুদ্রার অত্যধিক অবমূল্যায়ন মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতির আরও অবনতির কারণ হতে পারে। তাই আমরা যথোপযুক্ত নীতি গ্রহণ এবং সময়োপযোগী ও কার্যকর সমন্বয়সাধনকে প্রাধান্য দিচ্ছি।


বাজার ব্যবস্থাপনার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সুলভমূল্যে বিক্রয়, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি পরিচালনা, ১ কোটি পরিবারের জন্য ফ্যামিলি কার্ড ছাড়াও নির্দিষ্ট পণ্য অধিক হারে আমদানির সুযোগের মাধ্যমেও মূল্যস্ফীতিকে কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি। এছাড়া সরকারের পরিচালণ ব্যয়ে কৃচ্ছ সাধন ও মুদ্রানীতিতে সুদের হার বৃদ্ধি, মুদ্রা বিনিময় হারের প্রত্যাশিত স্থিতিশীলতা স্বল্প সময়ের মধ্যে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে সহায়ক হবে। একই সঙ্গে এটিও লক্ষণীয়, ব্যাংক উৎস হতে সরকারি ঋণ গ্রহণ কমছে, প্রকান্তরে যা মূল্যস্ফীতি হ্রাস করবে।


যুগান্তর : ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের চিহ্নিত করতে আপনি কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন কি?


আ হ ম মুস্তফা কামাল : নতুন আইনে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি চিহ্নিত করতে ৪টি সংজ্ঞা দেওয়া আছে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি চিহ্নিতকরণ কার্যক্রম আরও সুচারুরূপে সম্পাদন করতে এবং তাদের বিষয়ে অধিকতর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দরকার হলে বাংলাদেশ ব্যাংক আরও নির্দেশনা জারি করবে।


যুগান্তর : রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণের অঙ্ক অনেক, খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে আপনি কি সফল?


আ হ ম মুস্তফা কামাল : এটা ঠিক, সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের শ্রেণীকৃত ঋণ ইন্ডাস্ট্রি এভারেজের চেয়ে বেশি। এটি একদিনে হয়নি। ১৯৮৯ সালে প্রথম ঋণশ্রেণীকরণ হিসাব করা হয়, তখন থেকেই এ ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেশি। এরপরও ১৪ বছরে আমাদের সংস্কার কার্যক্রমের ফলে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ অনেক কমেছে।


২০০৯ সালে আমি দায়িত্ব নেওয়ার সময় সরকারি ব্যাংকগুলোয় ২৫ শতাংশ খেলাপি ঋণ ছিল। বর্তমানে ২১ শতাংশে কমিয়ে আনতে পেরেছি। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৩২ দশমিক ৪ শতাংশ। সর্বশেষ জুনে দাঁড়িয়েছে ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ। অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২২ দশমিক ৫ থেকে কমে ২১ দশমিক ৮ শতাংশ এবং সোনালী ব্যাংকে ৩১ দশমিক ৫ থেকে ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ হয়েছে। এরপরও সরকারি ব্যাংকগুলোকে আরও শক্তিশালী করতে কাজ করছি।


এখন ব্যাংকগুলোর আয়, প্রভিশন সংরক্ষণ, মূলধন সংরক্ষণ অবস্থার উন্নতির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রতিটি ব্যাংককে শ্রেণীকৃত ঋণ আরও কমিয়ে আনার জন্য সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে কোভিড-১৯ ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যে সকল ঋণ শ্রেণীকৃত হয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুসরণ করে ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে পুনঃতফশিল করা যাবে। খেলাপি ঋণ আদায়ে আইনি কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে হাইকোর্ট বিভাগে ৮টি পৃথক বেঞ্চ গঠন করা হয়েছে।


যুগান্তর : প্রভাবশালী হওয়ায় অনেক ঋণখেলাপি পার পাচ্ছে-অর্থমন্ত্রী হিসাবে এ ব্যাপারে আপনি কী বলবেন?


আ হ ম মুস্তফা কামাল : ঢালাওভাবে এ বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত নই যে, প্রভাবশালী কোনো ব্যক্তি কোনো প্রকার বিশেষ সুবিধা পাচ্ছে না। প্রতিটি ব্যাংকেই কোনো অনিয়ম হলেই এর বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ বিষয়ে নিয়মিত তদারকি করছে। আর ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করেছি। এতে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপী যতই প্রভাবশালী হোক না কোন, তিনি এবং তার গ্রুপভুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠান ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা পাবে না। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, জালিয়াতির মাধ্যমে নেওয়া কোনো ঋণ পুনঃতফশিলীকরণ হবে না।


শেয়ার করুন