২৮ এপ্রিল ২০২৪, রবিবার, ০৫:২৬:৪১ পূর্বাহ্ন
রাতের আঁধারে বেহাত হাজার একর জমি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০২-০৯-২০২৩
রাতের আঁধারে বেহাত হাজার একর জমি

নীলফামারীর ডিমলার তিস্তার চরে প্রায় দুই হাজার পরিবারের বসবাস। সম্প্রতি সেখানে হাজির হন রংপুরের সফিয়ার রহমান ও শাহ মো. মেহেদী হাসান নামের দুই ব্যক্তি। তাঁরা স্থানীয় লোকদের বলেন, তিস্তার চরে সোলার প্যানেল তৈরির কারখানা নির্মাণ করতে চান। তাঁদের প্রস্তাবে কয়েকজন রাজি হলে ‘কোম্পানির’ কাছে জমি বিক্রির জন্য পাওয়ার অব অ্যাটর্নি (আমমোক্তারনামা) চান ওই দুজন। এরপর পাওয়ার অব অ্যাটর্নির নামে কয়েকজনের কাছ থেকে স্বাক্ষর সংগ্রহ করা হয়। তাঁদের অজান্তেই জাল দলিল তৈরি করে লিখে নেওয়া হয় চরের ১ হাজার ৩৯ একর জমি। এসব জমির বাজারমূল্য প্রায় শতকোটি টাকা।


এভাবে দলিল লিখে নেওয়ার ঘটনাটি ঘটেছে গত ২২ জুন রাতে। দলিলে ২৭ জনের স্বাক্ষর থাকলেও মূলত স্বাক্ষর দিয়েছেন ১০-১২ জন। বাকি ব্যক্তিদের স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে। সম্প্রতি জমিতে চাষাবাদ করতে গিয়ে স্থানীয় লোকজন জানতে পারেন, পুরো তিস্তার চরের জমি এখন সফিয়ার ও মেহেদীর। কৃষিজমির পাশাপাশি অনেক পরিবারের বাড়িঘরও ওই দুজনের মালিকানাধীন। এতে সর্বস্বান্ত হওয়ার পথে চরের দুই হাজার পরিবার। প্রতিকার চেয়ে উপজেলা প্রশাসন ও জেলা প্রশাসনে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন তাঁরা। যাঁদের স্বাক্ষর নিয়ে জমি লিখে নেওয়া হয়েছে, তাঁদের কয়েকজন বলেছেন, তাঁরা জমি কেনাবেচার কিছুই জানেন না।


এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক পঙ্কজ ঘোষ বলেন, ‘অভিযোগের বিষয়টি শুনেছি। তবে অভিযোগের কপি এখনো হাতে পাইনি। কপি পেলে ব্যবস্থা নিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’


ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন, জাল দলিল তৈরি করে এভাবে এক হাজারের বেশি একর জমি হাতিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছে ডিমলার সাবরেজিস্ট্রার মনীষা রায় এবং দলিল লেখক মতিউর রহমান চৌধুরীর সহযোগিতায়।


মতিউর ডিমলার দলিল লেখক সমিতির সভাপতি। সাবরেজিস্ট্রার মনীষা রায়ের বাড়ি নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলায়। প্রতারণা করে জমি লিখে নেওয়া সফিয়ার রহমানের বাড়ি রংপুরের তারাগঞ্জে। আর মেহেদীর বাড়ি রংপুরের পীরগাছায়।


তিস্তার চর এলাকাটি পড়েছে ডিমলা উপজেলার ঝুনাগাছ চাপানি ইউনিয়নের ছাতুনামা মৌজায়। ভূমি অফিস ও স্থানীয় সূত্র বলেছে, ছাতুনামা মৌজার ১ হাজার ৩৯ একর জমি গত ২২ জুন সফিয়ার রহমান ও শাহ মো. মেহেদী হাসানের নামে ডিমলা সাবরেজিস্ট্রি অফিস থেকে রেজিস্ট্রিযুক্ত অপ্রত্যাহারযোগ্য আমমোক্তারনামা দলিল করা হয়। দলিল লেখক মতিউর রহমান চৌধুরীর সম্পাদনায় পাঁচটি দলিলের (দলিল নম্বর ৩২৫৯/২৩, ৩২৬০/২৩, ৩২৬১/২৩, ৩২৬২/২৩ এবং ৩২৬৩/২৩) মাধ্যমে জমি হস্তান্তর হয়। দলিলগুলোয় ডিমলা ও হাতিবান্ধা উপজেলার ২৭ জনকে বিক্রেতা হিসেবে দেখানো হয়েছে। জমি হাতছাড়া হওয়ার বিষয়টি গত আগস্টের মাঝামাঝি জানতে পারেন প্রকৃত মালিকেরা।


জমি হারানো স্থানীয় বাসিন্দাদের একজন মজিবর রহমান। তিনি বলেন, তিনি জমি বিক্রি করেননি। অন্য ব্যক্তিদের ভুয়া মালিক সাজিয়ে দলিল করা হয়েছে। তাঁদের জাল স্বাক্ষর ও ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করা হয়েছে জমির দলিলে। একই অভিযোগ করেছেন জমি হারানো অন্যরাও।


ভুক্তভোগীরা বলেন, সম্প্রতি জমি চাষ করতে গেলে তাঁদের বলা হয়, পুরো চরের জমি এখন সফিয়ার ও মেহেদীর। মালিকেরা তখন জানতে পারেন, তাঁদের অগোচরে জাল দলিলে বসতভিটাসহ ফসলি জমি বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।


আমমোক্তারনামায় স্বাক্ষর করা বাহাদুর, ছফের আলী, আব্দুল লতিফ, রেজাউলসহ অন্তত ১০ জনের সঙ্গে কথা হয় আজকের পত্রিকার প্রতিনিধির। তাঁরা বলেছেন, সফিয়ার ও মেহেদী তিস্তার চরে তাঁদের জমিতে সোলার প্যানেল কারখানা নির্মাণের প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবে রাজি হলে ওই দুজন জানান, কোম্পানির কাছে জমি বিক্রির আলোচনার জন্য প্রতিনিধি হিসেবে তাঁদের দুজনকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিতে হবে। তবে কোন কোম্পানির কাছে জমি বিক্রি হবে, তা ওই দুজন জানাননি। স্থানীয় ১০-১২ জন সশরীরে হাজির হয়ে শুধুমাত্র ‘কোম্পানির’ সঙ্গে আলোচনার জন্য পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দেন। কিন্তু পরে জানতে পারেন, তাঁরা প্রতারণার শিকার হয়েছেন। তাঁদের কাছ থেকে জমি লিখে নেওয়া হয়েছে, দলিলে ইচ্ছেমতো জমির পরিমাণও বসিয়ে নেওয়া হয়েছে। এমনকি যেসব জমির মালিক তাঁরা নন, সেসব জমিও তাঁদের জমি বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে তাঁরা মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানান।


ছফের আলী বলেন, ‘জলঢাকা উপজেলায় সাবরেজিস্ট্রার মনিষা রায়ের বাড়িতে তাঁরা আমাদের ডেকে নেন। রাত ১০টার দিকে দলিল রেজিস্ট্রি সম্পন্ন হয়। দলিলে কী লেখা হয়েছে, আমাদের না জানিয়ে স্বাক্ষর নিয়েছেন সাবরেজিস্ট্রার মনীষা। পরে জানতে পারি, আমাদের ভুয়া মালিক সাজিয়ে অন্যের জমি লিখে নিয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, তিস্তার চরে তাঁর মাত্র দুই একর জমি আছে।


বাহাদুর বলেন, যে পরিমাণ জমি তাঁদের স্বাক্ষরে লিখে নেওয়া হয়েছে, এত জমির মালিক তাঁরা নন। তাঁরা ১০-১২ জন মিলে মোটের ওপর ১৫ একর জমির মালিক হবেন। কিন্তু দলিলে তাঁদের জমির পরিমাণ ইচ্ছেমতো বাড়িয়ে উল্লেখ করা হয়েছে।


আব্দুল লতিফ বলেন, তিনি স্বাক্ষর দিতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর ছোট ভাই আব্দুস সামাদ যাননি। তারপরও দলিলে তাঁর জাল স্বাক্ষর রয়েছে। তাঁর মতো প্রায় ১৫ জনের স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে। দলিলে তাঁদের জীবিত বাবাকে মৃত উল্লেখ করা হয়েছে। আবদুল লতিফ আরও বলেন, তিস্তার চরে তাঁর ১ একর ৯০ শতাংশ জমি আছে। আর তাঁর ভাই আব্দুস সামাদের জমি আছে এক একর।


তবে মনীষা রায় অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখে জমি রেজিস্ট্রি করা হয়। দলিল লেখক মতিউর রহমানের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওই দলিলগুলো করা হয়েছে। এখন দাতারা যদি কোনো অভিযোগ করেন, তাহলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


আর দলিল লেখক মতিউর রহমান বলেন, ‘সাবরেজিস্ট্রার কাগজপত্র দেখে দলিল রেজিস্ট্রি করেছেন। কাগজপত্র ঠিক না থাকলে জমি রেজিস্ট্রি কীভাবে হলো?’ একই কথা বলেছেন জমিগুলো কিনে নেওয়া দুই ক্রেতার একজন সফিয়ার রহমানও। অভিযোগের বিষয়ে জানতে মেহেদী হাসানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।


স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, ডিমলা উপজেলায় জাল দলিলের একটি চক্র সৃষ্টি হয়েছে। এর আগেও অনেকে এ চক্রের প্রতারণার শিকার হয়েছেন। প্রতিবাদ করলেই মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, সাবরেজিস্ট্রার মনীষার বিরুদ্ধে এর আগেও জাল দলিলে জমি রেজিস্ট্রির অভিযোগ রয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে এ-সংক্রান্ত মামলাও হয়েছে।


এর আগে প্রতারণার শিকার হন জমি হারানো ব্যক্তিদের একজন ডিমলার খড়িবাড়ি এলাকার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা হারুন অর রশিদ। তিনি বলেন, তিনি সাবরেজিস্ট্রার মনীষাকে তাঁর জমির মূল কাগজপত্র দেখিয়ে রেজিস্ট্রি বন্ধের আবেদন করেছিলেন। বিষয়টি তিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকেও (ইউএনও) লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন। কিন্তু সাবরেজিস্ট্রার ভুয়া মালিক রণজিতের জাল দলিল ও নামজারি দিয়ে জমি রেজিস্ট্রি করে দিয়েছেন।


ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নুর-ই-আলম সিদ্দিকী আজকের পত্রিকাকে বলেন, জাল দলিল করে পুরো চরের জমি দখলের অভিযোগ উপজেলা প্রশাসনে জমা পড়েছে। তবে অভিযোগটি এখনো তিনি দেখতে পারেননি। তিনি সদ্য ডিমলায় যোগ দিয়েছেন। অভিযোগটি জমা পড়েছে তাঁর আগে যিনি ইউএনও ছিলেন, তাঁর সময়ে। অভিযোগটি দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।


শেয়ার করুন