২৩ ডিসেম্বর ২০২৫, মঙ্গলবার, ০৩:৩৮:৩৬ পূর্বাহ্ন
বিপাকে সাড়ে ৩ হাজার শিক্ষক-সাংবাদিক, আইনি লড়াইয়ের প্রস্তুতি
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৮-১২-২০২৫
বিপাকে সাড়ে ৩ হাজার শিক্ষক-সাংবাদিক, আইনি লড়াইয়ের প্রস্তুতি

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন ‘এমপিও নীতিমালা-২০২৫’ জারির পর শিক্ষকতার পাশাপাশি সাংবাদিকতায় যুক্ত থাকা দেশের প্রায় সাড়ে তিন হাজার মফস্বল সাংবাদিক চরম সংকটে পড়েছেন। 


গত ৭ ডিসেম্বর জারি করা এই নীতিমালায় স্পষ্ট করা হয়েছে যে, এমপিওভুক্ত কোনো শিক্ষক বা কর্মচারী একই সঙ্গে একাধিক চাকরি বা সাংবাদিকতা ও আইন পেশার মতো লাভজনক পদে থাকতে পারবেন না। এই নিয়ম লঙ্ঘন করলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-কর্মচারীর এমপিও বাতিল করার বিধান রাখা হয়েছে। 


এই সিদ্ধান্তের ফলে সারা দেশের কয়েক হাজার শিক্ষক-সাংবাদিকের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা দিয়েছে এবং তারা এই নীতিমালাকে চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে রিট করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে নবগঠিত ‘এমপিওভুক্ত শিক্ষক-সাংবাদিক গ্রুপ’ সূত্রে জানা গেছে।


নতুন এই জনবল কাঠামো ও নীতিমালা দেশজুড়ে শিক্ষকসমাজে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের অনেক প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত। অনেক শিক্ষক জাতীয় ও স্থানীয় বিভিন্ন পত্রিকা বা টেলিভিশন চ্যানেলের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। তাদের মতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালনের পর সৃজনশীল বা সমাজসেবামূলক কাজে যুক্ত থাকা কোনো অন্যায় নয়। 


এই লক্ষ্যে ইতিমধ্যে ‘এমপিওভুক্ত শিক্ষক-সাংবাদিক গ্রুপ’ এবং ‘বাংলাদেশ বেসরকারি শিক্ষক-সাংবাদিক অধিকার সংরক্ষণ ফোরাম’ গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। গ্রুপটির আহ্বায়ক এবং শেরপুর মডেল গার্লস কলেজের সহকারী অধ্যাপক মাসুদ হাসান বাদল জানিয়েছেন, প্রায় সাড়ে তিন হাজার শিক্ষক সাংবাদিকতায় যুক্ত রয়েছেন। তিনি দাবি করেন, সাংবাদিকতা কোনো দ্বৈত পেশা নয় এবং তারা এখান থেকে নামমাত্র সম্মানী পান, যা কোনোভাবেই বেতনভুক্ত পদের মতো নয়।


শিক্ষকদের অভিযোগ, জনপ্রতিনিধি বা কাজি হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা না থাকলেও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এই নিষেধাজ্ঞা প্রশাসনের একটি অংশের ক্ষোভের প্রতিফলন। মাদারীপুরের শিক্ষক ও সাংবাদিক মো. রফিকুল ইসলাম প্রশ্ন তুলেছেন যে, সরকারি চিকিৎসকরা যদি দায়িত্ব শেষে ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখতে পারেন, তবে শিক্ষকদের সাংবাদিকতা কেন অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। 


অনেক শিক্ষক হয়রানির ভয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষকরা লেখালেখি বন্ধ করলে তৃণমূল পর্যায়ে সাংবাদিকতার মান আরও নিচে নেমে যাবে। তারা মনে করছেন, এই নীতিমালার মাধ্যমে শিক্ষকদের সৃজনশীলতার পথ রুদ্ধ করা হচ্ছে।


নীতিমালা জারির পর ইতিমধ্যে মাঠ পর্যায়ে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। গাইবান্ধা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আতাউর রহমান একটি আদেশের মাধ্যমে সাত উপজেলার মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন তার আওতাধীন কতজন শিক্ষক সাংবাদিকতা বা আইন পেশায় যুক্ত আছেন, তার পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাঠাতে। ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে এই তথ্য সংগ্রহের সময়সীমা নির্ধারিত ছিল। 


জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নীতিমালা অনুযায়ী কোনো শিক্ষক লাভজনক অন্য পেশায় যুক্ত থাকতে পারবেন না এবং তথ্য যাচাই শেষে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বর্তমানে সারাদেশে মাধ্যমিক, মাদ্রাসা ও কারিগরি মিলিয়ে প্রায় ছয় লাখের বেশি শিক্ষক ও কর্মচারী এমপিওভুক্ত রয়েছেন।


তদন্তে জানা গেছে, জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনে ডিসিদের দেওয়া প্রস্তাবের ভিত্তিতেই সরকার এই কঠোর অবস্থান নিয়েছে। গত ১৭ নভেম্বর প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ডিসিদের মতবিনিময় সভায় যুক্তি দেওয়া হয় যে, এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা জাতীয় নির্বাচনে প্রিসাইডিং ও পোলিং অফিসার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। 


তারা যদি প্রকাশ্যে সাংবাদিকতা বা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকেন, তবে সুষ্ঠু ভোট গ্রহণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতে পারে। এর আগে ২০২৩ সালের ডিসি সম্মেলনেও শিক্ষকদের জন্য সরকারি কর্মচারীদের মতো আচরণ বিধিমালা তৈরির প্রস্তাব করা হয়েছিল, যাতে শিক্ষকতার পাশাপাশি ঠিকাদারি বা সাংবাদিকতা বন্ধ করা যায়।


শিক্ষক সংগঠনগুলোর মধ্যে এই নীতিমালা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। একদল এই উদ্যোগকে শিক্ষার মানোন্নয়নে ইতিবাচক মনে করলেও অন্য পক্ষ মনে করছে, এটি বৈষম্য ও অস্থিরতা তৈরি করবে। 


এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণপ্রত্যাশী জোটের সদস্যসচিব দেলাওয়ার হোসেন আজিজী বলেন, নীতিমালায় কিছু ইতিবাচক দিক থাকলেও সাংবাদিকতা ও আইন পেশাকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা উচিত। যোগ্য শিক্ষকদের সাংবাদিকতার পথ বন্ধ করা হলে স্থানীয় গণমাধ্যম আরও দুর্বল হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।


শেয়ার করুন