মানুষ মৃত্যুর পর দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও এমন কিছু আমল অব্যাহত আছে, যা কিয়ামত পর্যন্ত ব্যক্তির জন্য সওয়াবের ধারাবাহিক উৎস হয়ে থাকে। সে মুত্যুর পরও সেসব আমলের জন্য সওয়াব পেতে থাকে-
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ " إِذَا مَاتَ الإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلاَّ مِنْ ثَلاَثَةٍ إِلاَّ مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ " .
আবূ হুরাইরাহ (রা.) হতে বর্ণিত যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যখন মানুষ মৃত্যুবরণ করে তখন তার সমস্ত আমল বন্ধ হয়ে যায় তিন প্রকার আমল ছাড়া। ১. সাদাকা জারিয়াহ্ অথবা ২. এমন ইলম যার দ্বারা উপকার হয় অথবা ৩. পুণ্যবান সন্তান যে তার জন্যে দু’আ করতে থাকে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৬৩১)
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা
উপরোক্ত হাদিসে মহানবী (সা.) এমন তিনটি আমলের দিকে দিকনির্দেশনা করেছেন।
যেগুলোতে মানুষের মৃত্যুর পরও সওয়াবের ধারা অব্যাহত থাকে। যা ইসলামী সমাজে “সাওয়াবে জারিয়া” নামে পরিচিত।
১. সাদাকায়ে জারিয়া
‘সাদাকায়ে জারিয়া’ বলতে বোঝানো হয় এমন দান, যার সুফল বা উপকার নিরন্তরভাবে অন্যরা পেতে থাকে; যতক্ষণ তা থেকে উপকার পাওয়া যায়, ততক্ষণ দাতার জন্য সওয়াব অব্যাহত থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- মসজিদ নির্মাণ করা, কূপ বা পানির ব্যবস্থা করা, পথচারীর বিশ্রামের স্থান তৈরি করা, পবিত্র কোরআনের ছাপাখানা বা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা।
কোনো এতিমখানা, হাসপাতাল, বা জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে দেয়া।
এসব দান কেবল সম্পদের দান নয়, বরং আত্মার দানও। মানুষ মরে গেলেও, যখন তার স্থাপিত কূপের পানি কেউ পান করে, তার নির্মিত মসজিদে কেউ নামাজ পড়ে, কিংবা তার দানকৃত বই থেকে কেউ আলোকিত হয়—তখন প্রতিটি মুহূর্তে তার আমলনামায় নতুন সওয়াব যুক্ত হয়। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে- ‘যে ব্যক্তি সৎকর্ম করে, সে নিজের আত্মারই মঙ্গল করে।
’ (সরা ফুসসিলাত আয়াত:৪৬)
২. উপকারী ইলম
উপকারী ইলম বলতে বোঝঅনো হয় - এমন জ্ঞান, শিক্ষা বা গবেষণাকর্ম যা মানুষের উপকারে আসে—তা ধর্মীয় হোক বা পার্থিব—এবং যার দ্বারা অন্যরা ক্রমাগত উপকৃত হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- আলেম বা শিক্ষক যিনি মানুষকে কোরআন ও হাদিস শিক্ষা দেন। কোনো লেখক যিনি ইসলামি শিক্ষা, নৈতিকতা বা বিজ্ঞানভিত্তিক উপকারী গ্রন্থ রচনা করেন। কোনো গবেষক যিনি মানবতার কল্যাণে জ্ঞান রেখে যান। এমনকি কেউ কোনো দ্বীনি ওজনদার লেকচার, ব্যাখ্যা বা ওয়াজ রেখে যান যা পরবর্তী প্রজন্ম উপকৃত হয়।
ইমাম নববী (রহ.) বলেন: ‘ইলমে নাফে (উপকারী জ্ঞান) বলতে সেই জ্ঞানকে বোঝায় যা মানুষকে আল্লাহর দিকে পরিচালিত করে, পাপ থেকে বিরত রাখে, ও মানবকল্যাণে ব্যবহার হয়।’ (শারহ মুসলিম, নববী)
ইলম আল্লাহর নূর, যা মৃত্যুর পরও মানুষের আত্মাকে আলো দেয়। এমন ইলম অর্জন ও প্রচার করা কেবল নিজের নাজাতের পথ নয়, বরং পরবর্তী প্রজন্মের হিদায়াতের মাধ্যম।
৩. নেক সন্তান, যে তার জন্য দোয়া করে
নেক সন্যেতান হচ্ছে সে সন্তান যে তার পিতা-মাতার মৃত্যুর পরও আল্লাহর নিকট তাদের জন্য ক্ষমা ও মাগফিরাত প্রার্থনা করে, সে সন্তানের দোয়া মৃত পিতা-মাতার জন্য এক নিরবচ্ছিন্ন সওয়াবের সেতু। ইমাম কুরতুবী (রহ.) বলেন: ‘সন্তান পিতার উপার্জিত বীজের ফল। তাই সন্তানের দোয়াও পিতার আমলের পরিণতি হিসেবে গৃহীত হয়।’
হাদিসের এ অংশে মহানবী (সা.) পিতা-মাতার জন্য এক স্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। তা হলো- সন্তানকে শুধু জীবিকা অর্জনের জন্য নয়, দ্বীনের উত্তরাধিকারী হিসেবেও গড়ে তোলতে হবে। কারণ সন্তান যদি নেক হয়, তার প্রতিটি সৎকর্মও পিতা-মাতার জন্য সওয়াব বয়ে আনে।
এই হাদিস মানুষকে মৃত্যুর পরের জীবন নিয়েও সচেতন করে। মৃত্যু কোনো সমাপ্তি নয়, বরং নতুন অধ্যায়ের সূচনা—যেখানে কাজ করে কেবল সেইসব আমল, যেগুলো মানুষের পেছনে রেখে যাওয়া প্রভাবের মাধ্যমে চলমান থাকে।
তাই আজ থেকেই নিজেকে প্রশ্ন করা দরকার—
আমি কি এমন কোনো সদকা করছি, যা মৃত্যুর পরও চলবে?
আমি কি এমন কোনো জ্ঞান ছড়াচ্ছি, যা মানুষকে উপকৃত করবে?
আমি কি আমার সন্তানকে এমনভাবে গড়ে তুলছি, যেন সে আমার জন্য জান্নাতের দ্বার খুলে দেয়?
হাদিসটি মানুষকে শিক্ষা দেয় তিনটি মূলনীতি
দান করুন, যা মৃত্যুর পরও কথা বলবে।
জ্ঞান দিন, যা অন্ধকারে আলো জ্বালাবে।
সন্তান গড়ুন, যে আপনার মৃত্যুর পরও আপনার নাম আল্লাহর সামনে উচ্চারণ করবে।

