ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে নওহাটা বাজারের নওগাঁ-রাজশাহী মহাসড়কের দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে ইঞ্জিনচালিত ভ্যান, নসিমন, করিমন ও ভুটভুটিতে বোঝাই করে সোনালী আঁশ—পাট নিয়ে হাজির হন কৃষক ও মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা। সপ্তাহে সোমবার ও বৃহস্পতিবার সকাল ৫টা থেকে ৯টা পর্যন্ত বসে এই সাপ্তাহিক পাটের হাট। এখানে মানভেদে দর কষাকষির মাধ্যমে চলে জমজমাট বেচাকেনা। পাইকারি ব্যবসায়ীরা এসব পাট কিনে নিয়ে যান স্থানীয় গুদামে।
গত বৃহস্পতিবারও নওহাটা হাটে চোখে পড়ার মতো পাটের সরবরাহ ছিল। মৌসুমের শুরুতে তুলনামূলক কম সরবরাহ থাকলেও বর্তমানে ক্রেতা-বিক্রেতাদের ভিড়ে জমজমাট হাট বসেছে। এই হাটসহ জেলার বিভিন্ন হাটে কয়েক সপ্তাহ ধরে পাটের রমরমা কেনাবেচা হচ্ছে। এছাড়াও রাজশাহী জেলায় চালু থাকা পাঁচটি জুট মিল সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে পাট ক্রয় করছে। ফলে গত বছরের তুলনায় এবার মণপ্রতি প্রায় এক হাজার টাকা বেশি দামে পাট বিক্রি করছেন কৃষকেরা।
নওহাটা পৌরসভার শ্রীপুর গ্রামের পাট ব্যবসায়ী সাব্বির আহমেদ বলেন,এখন থেকে সরবরাহ আরও বাড়বে। তবে দাম পড়ে যাবে কি না, সে নিয়ে আমাদের মধ্যে শঙ্কা আছে। সপ্তাহখানেক আগে মণপ্রতি দাম ছিল ৩ হাজার ৯০০ টাকা, কিন্তু গতকাল তা এক থেকে দেড়শ টাকা কমেছে। তবুও কৃষকেরা খুশি মনে বিক্রি করছেন।”
গত বছরের তুলনায় এবার কৃষকেরা মণপ্রতি ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা বেশি পাচ্ছেন। গত বছর নতুন পাট বিক্রি হয়েছিল ২ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকা দরে। এবার সেই দাম উঠেছে মণপ্রতি ৩ হাজার ৬০০ থেকে ৩ হাজার ৯০০ টাকায়।
উপজেলার পুঠিয়াপাড়ার কৃষক মামুন অর রশিদ জানান,আমি আজকে ২২ মণ পাট ৩ হাজার ৬০০ টাকা দরে বিক্রি করেছি। জমি লিজ নেয়া, বীজ, সার, শ্রমিক, সেচসহ সব খরচ মিলিয়ে বিঘাপ্রতি খরচ হয়েছে প্রায় ২০ হাজার টাকা। ফলনও ভালো হয়েছে। তাই বিঘাপ্রতি খরচ বাদে ১৬ থেকে ১৮ হাজার টাকা লাভ পেয়েছি।”
চর খিদিরপুর গ্রামের কৃষক চান্দ শেখ বলেন, আমি তিন বিঘা জমিতে ২৮ মণ পাট তুলেছি। নিজস্ব জমিতে খরচ হয়েছে ৫৫ হাজার টাকা, আর বিক্রি করেছি এক লাখ পাঁচ হাজার টাকায়। এতে নিট লাভ হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। গত বছরের তুলনায় এ বছর মণপ্রতি প্রায় ১ হাজার ৬০০ টাকা বেশি লাভ পেয়েছি।”
চর খানপুরের ব্যবসায়ী ইনসান আলী জানান, আমরা সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে পাট কিনে হাটে বিক্রি করি। সব খরচ বাদে মণপ্রতি একশ থেকে দেড়শ টাকা লাভ থাকে।”
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর জেলায় ১৭ হাজার ৩০৫ হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়েছে, যা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার (১৭,১৮৫ হেক্টর) চেয়ে ১২০ হেক্টর বেশি। অনুকূল আবহাওয়ার কারণে গড়ে প্রতি বিঘায় নয় থেকে দশ মণ পাট পাওয়া গেছে। পর্যাপ্ত বৃষ্টির কারণে জাগ দেওয়ার জন্য পানির অভাব হয়নি।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক উম্মে ছালমা বলেন,আবহাওয়া, ফলন ও দাম অনুযায়ী এবার কৃষক পাট চাষে লাভজনক অবস্থায় আছেন। আমাদের হিসাবে প্রতি বিঘায় নয় থেকে দশ মণ পাট পাওয়া গেছে এবং বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী প্রতি মণে কৃষকের ১ হাজার ২০০ টাকার বেশি লাভ হচ্ছে। পাট বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ও লাভজনক অর্থকরী ফসল। শুধু স্থানীয় বাজারেই নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও এর চাহিদা রয়েছে। তাই কৃষকদের আমরা উৎসাহিত করছি যেন তারা পাটচাষে আগ্রহী হন। আমরা সার, বীজ, আধুনিক উৎপাদন প্রযুক্তি, রোগবালাই ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে জাগ দেওয়া পর্যন্ত সব বিষয়ে মাঠপর্যায়ে সহায়তা দিচ্ছি।”
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের রাজশাহীর উপপরিচালক শাহানা আক্তার জাহান বলেন,কৃষকের উৎপাদিত পাট যেন ন্যায্যমূল্যে বিক্রি হয়, সে জন্য আমরা নিয়মিত বাজার মনিটরিং করছি। ব্যবসায়ীরা যেন অযথা দাম কমিয়ে না দেন এবং কৃষকের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত হয়, এ বিষয়ে বাজার কমিটিকে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাট বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী রপ্তানিযোগ্য ফসল। তাই কৃষককে লাভবান রাখতে হলে মধ্যস্বত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণ এবং বাজার ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।”
পাট অধিদপ্তর রাজশাহীর সহকারী পরিচালক মো. নাদিম আক্তার জানান, পাটের বাজার ব্যবস্থাপনা ও মূল্য স্থিতিশীল রাখতে আমরা কাজ করছি। কৃষকদের জন্য বাজারে সঠিক তথ্য পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। সরকার অভ্যন্তরীণ ব্যবহার বৃদ্ধিতে ২০১০ সালের বাধ্যতামূলক পাটজাত মোড়ক আইন বাস্তবায়নে সচেষ্ট রয়েছে। রাজশাহীতে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় আইন অমান্যকারীর বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়। এছাড়া কাঁচা পাটের রপ্তানি নীতির কারণে কৃষকেরা ন্যায্য দাম পাচ্ছেন।”
তিনি আরও জানান, রাজশাহী জুট মিলসহ জেলায় মোট সাতটি জুট মিল রয়েছে। এসব মিল কৃষকদের কাছ থেকে ন্যায্য মূল্যে সরাসরি পাট ক্রয় করে থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় পুঠিয়া উপজেলার রহমান জুট স্পিনার্সের ১০০ মেট্রিক টন উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে। এছাড়া রহমান জুট মিলের ২০ মেট্রিক টন, হাসেন জুট মিলের ১৮ মেট্রিক টন, নওহাটা জুট মিল ও আমান জুট ফাইবার্সের ১৫ মেট্রিক টন উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে। বাকি দুটি জুট মিল বন্ধ রয়েছে।”

