ঢাকার উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার মর্মান্তিক ঘটনায় পুরো দেশ শোকাহত। সোমবার (২১ জুলাই) দুপুরে প্রশিক্ষণ চলাকালে বিমানটি আছড়ে পড়ে একটি স্কুল ভবনের ওপর। ভয়াবহ আগুনে পুড়ে মারা গেছে ৩১ জন, আহত অবস্থায় এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৬৮ জন। অধিকাংশই শিশু শিক্ষার্থী। ঘটনার পরপরই যুদ্ধবিমানের নিরাপত্তা, রক্ষণাবেক্ষণ এবং পুরনো প্রযুক্তি নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে। এসব প্রশ্নের জবাব দিতে মঙ্গলবার (২২ জুলাই) সরাসরি সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হন বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান।
তিনি জানান, বিধ্বস্ত হওয়া এফ-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমানটি প্রযুক্তিগতভাবে পুরনো হলেও তার কার্যক্ষমতা এখনও অক্ষুণ্ণ ছিল এবং বিমান বাহিনী রক্ষণাবেক্ষণে কোনো রকমের শিথিলতা করে না। তাঁর ভাষায়, “প্রত্যেকটা বিমানেরই একটা নির্দিষ্ট ‘লাইফ টাইম’ থাকে। এ ধরনের বিমানের ৩০ বছরের কার্যক্ষমতা থাকে। বয়স নয়, রক্ষণাবেক্ষণই আসল বিষয়।”
ঘটনার সময় তিনি তুরস্ক সফরে থাকলেও সংবাদ পাওয়ার পরপরই দেশে ফিরে আসেন। সেই বেদনাদায়ক পরিস্থিতি স্মরণ করে তিনি বলেন, “সংবাদটি পেয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। এ এক অপূরণীয় ক্ষতি, যা কখনো পূরণীয় নয়।”
বিধ্বস্ত বিমানটির পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম ছিলেন একজন তরুণ এবং অভিজ্ঞ এভিয়েটর। তিনি শেষ মুহূর্তে চেষ্টা করেন বিমানটিকে জনবসতিহীন একটি স্থানে নামাতে। এজন্য সময়ক্ষেপণ হওয়ায় ইজেকশন সিস্টেম (বিমান থেকে জরুরি প্রস্থানের প্রযুক্তি) ব্যবহার করে বের হয়ে আসার সুযোগ পাননি। বিমান বাহিনী প্রধান বলেন, “তিনি নিয়ন্ত্রণ হারানোর পরও চেষ্টা করেছেন যেন ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার ওপর না পড়ে। তার এই আত্মত্যাগ আমাদের হৃদয় স্পর্শ করে।”
বিমান বাহিনীর বহরে থাকা এফ-৭ বিজিআই চীনের তৈরি একটি যুদ্ধবিমান, যার উৎপাদন বন্ধ হয় ২০১৩ সালে। যদিও বাংলাদেশ ২০১১ সালে এই মডেলের ১৬টি বিমান কিনে এবং তা ২০১৩ সালে বহরে যুক্ত হয়। এর ভিত্তি মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নের মিগ-২১ যুদ্ধবিমানের উন্নত সংস্করণ। এ নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও বিমান বাহিনী প্রধান পরিষ্কার ভাষায় বলেন, “এই বিমানগুলো আমরা যথাসম্ভব ভালোভাবে মেরামত করি। বিদেশি প্রযুক্তি সরবরাহকারী দেশ থেকেও প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ সামগ্রী ও সেবা সংগ্রহ করি। ইঞ্জিনের ফ্লাইট আওয়ারও মেনে চলা হয়। এক ঘণ্টাও অতিরিক্ত ওড়ানো হয় না।”
তবে তিনি স্বীকার করেন, প্রযুক্তিগতভাবে বিমানটি কিছুটা পিছিয়ে গেছে। “নতুন প্রযুক্তির যুদ্ধবিমান সংগ্রহে আমরা উদ্যোগ নিয়েছি,” জানিয়ে তিনি বলেন, “তবে উন্নত বিশ্বের অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমানও দুর্ঘটনায় পড়ে। কিছুদিন আগেই একটি এফ-৩৫ দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছিল। গ্যারান্টি কেউ দিতে পারে না।”
উত্তরার মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় প্রশিক্ষণ কেন দেওয়া হচ্ছিল, এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “১৯৮৫ সালে যখন আমি কুর্মিটোলা ঘাঁটিতে প্রশিক্ষণ নিতাম, তখন উত্তরা বলে কিছু ছিল না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জনসংখ্যা বেড়েছে। আমাদের কুর্মিটোলা ঘাঁটিটি দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি, যেখান থেকে প্রধান শহর ও ভিআইপি এলাকা নিয়ন্ত্রণে থাকে।”
বিমানের ইঞ্জিন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া গুজব ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্যের প্রতি ইঙ্গিত করে বিমান বাহিনী প্রধান বলেন, “আমাদের কোনো কিছু গোপন করার নেই। যা ঘটেছে, তা দুঃখজনক। তবে প্রতিটি তথ্যই আমরা আইএসপিআরের মাধ্যমে আপনাদের জানাচ্ছি। দয়া করে গুজবে কান দেবেন না। শক্তিশালী বিমান বাহিনী দেশের সার্বভৌমত্বের রক্ষাকবচ। তাকে দুর্বল করার চেষ্টা করবেন না।”
তিনি আরও বলেন, “এই সঙ্কটে যারা গুজব ছড়াচ্ছেন, তারা জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছেন।”
তিনি জানান, ইতোমধ্যে উচ্চ পর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত চলছে। পাইলট না থাকায় এবং বিমান সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় তদন্তে সময় লাগতে পারে। “তবে কোনো গাফিলতি বা ত্রুটি ধরা পড়লে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে,” আশ্বাস দেন তিনি।
এই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেন বিমান বাহিনী প্রধান। তিনি বলেন, “আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করাই এখন আমাদের প্রধান দায়িত্ব। পাশাপাশি নিহতদের পরিবারগুলোর পাশে থাকবে বিমান বাহিনী ও সরকার।”