০১ জুন ২০২৫, রবিবার, ১০:৫৪:০৪ অপরাহ্ন
পতিত সরকারের অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নিয়েই চলছে বর্তমান সরকার
  • আপডেট করা হয়েছে : ৩১-০৫-২০২৫
পতিত সরকারের অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নিয়েই চলছে বর্তমান সরকার

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার পতিত সরকারের অতিমূল্যায়িত ও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নিয়েই চলছে বলে মন্তব্য করেছেন গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো এবং বাংলাদেশে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।


আগের প্রকল্পগুলো প্রণয়নের সঙ্গে যারা জড়িত তারাই এখনো দায়িত্বে উল্লেখ করে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘মূল সমস্যা হচ্ছে আমরা আগের কাঠামোর কাছেই জিম্মি হয়ে রইলাম। তাছাড়া এগুলো যারা করেছে তারাই এখনো দায়িত্বে। প্রশাসনিকভাবেই শুধু নয়, এসব প্রকল্পের সঙ্গে যারা আর্থিক ও পেশাগতভাবে যুক্ত ছিলেন ভেতরে ও বাইরে তারাই এখনো এর সঙ্গে রয়ে গেছেন।


ফলে এর ব্যত্যয় হওয়ার কোনো সুযোগ আমি দেখছি না।’

সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগ স্থানীয় সরকার এবং পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়ের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ বেশ পুরনো। বিশেষ করে এ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলোকে ঘিরে প্রায়ই অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। গত বছরের আগস্টে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর পতিত সরকারের লুটপাটের প্রকল্পগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে—এমনটাই প্রত্যাশা ছিল সবার।


যদিও বাস্তবে এর প্রতিফলন নেই বললেই চলে। পতিত সরকারের সময়ে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের নেয়া প্রকল্পগুলো এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। 

আওয়ামী সরকারের সময়ে প্রণয়ন করা চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) এ মন্ত্রণালয়ের অধীনে যেসব প্রকল্প ছিল বর্তমান সময়ের সংশোধিত এডিপিতে (আরএডিপি) এসব প্রকল্পের প্রায় সবই স্থান পেয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে বরাদ্দও বেড়েছে।


যখন যে দল ক্ষমতায় এসেছে সে দলের প্রভাবশালী ব্যক্তি বা রাজনীতিকরাই গুরুত্বপূর্ণ এই স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় পরিচালনা করে এসেছেন। নগর থেকে গ্রাম—সব ক্ষেত্রেই এ মন্ত্রণালয়ের অধীন বাস্তবায়িত হয় ছোট-বড় নানা প্রকল্প। আর এসব প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে রয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের মতো গুরুতর অভিযোগ। মূলত রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন কাজ বাগিয়ে নেয়ারও অভিযোগ ওঠে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। একই পথে হাঁটছে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দায়িত্ব পাওয়া অন্তর্বর্তী সরকার।


মন্ত্রণালয়টিতে পতিত আওয়ামী লীগ আমলে নেয়া বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প থেকে বর্তমানে দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও অনৈতিক সুবিধা নেয়ার অভিযোগ উঠেছে।

গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা এএফ হাসান আরিফ। তার মৃত্যুর পর দায়িত্ব দেয়া হয় শেখ হাসিনা সরকার পতন আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াকে, যিনি আগের মন্ত্রী তাজুল ইসলামের প্রকল্পগুলোই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।


বিশ্লেষকরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার বিগত সরকারের বাজেট ও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) নিয়ে চলছে। অথচ এগুলো নীতিগতভাবে সংশোধন, পরিমার্জন ও পুনর্বিন্যাসের প্রয়োজন ছিল। সেই সঙ্গে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া প্রকল্পগুলোকে বদলানোর কথাও বলছেন তারা। পাশাপাশি এডিপিতে প্রকল্পের সংখ্যা কমানোর ওপরও জোর দেন বিশ্লেষকরা, যাতে উচ্চ অগ্রাধিকারে থাকা কাজগুলো করা যায়।


পরিকল্পনা বিভাগের তথ্যানুসারে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের এডিপিতে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতে ১০২টি প্রকল্পের জন্য ১৭ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে জিওবি (সরকারি অর্থায়ন) ১৩ হাজার ৪৯২ কোটি ও প্রকল্প ঋণ বা অনুদান ৪ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা। সংশোধিত এডিপিতে প্রকল্পের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১২-এ। প্রকল্পের সংখ্যা বাড়লেও এক্ষেত্রে মোট বরাদ্দের পরিমাণ কিছুটা কমে হয়েছে ১৬ হাজার ৯০৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে সংশোধিত এডিপিতে জিওবি ১৩ হাজার ৫৫২ কোটি ও প্রকল্প ঋণ বা অনুদান ৩ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা। এডিপির তুলনায় আরএডিপিতে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতে নতুন করে যুক্ত হয়েছে আরো ১০টি প্রকল্প।


সরকার পরিবর্তন হলেও এসব প্রকল্প রয়ে গেছে উল্লেখ করে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, উত্তরাধিকার সূত্রে যে প্রকল্পগুলো সরকার পেয়েছে সেগুলো বদলাতে না পারলে তো যেমন আছে তেমন চলতে থাকবে। এসব প্রকল্পে মন্ত্রণালয়ের সম্পৃক্ততা থাকে, ফলে এখানে আমলাতন্ত্রের স্বার্থ রয়েছে। সেই সঙ্গে স্থানীয় পর্যায়ে কিছু স্বার্থান্বেষী গ্রুপও গড়ে ওঠে। তাই নতুন সরকার এসে যে খুব সহজে এগুলো পরিবর্তন করে ফেলতে পারবে তা নয়। অবশ্য এ খাতে ছোট ও স্বল্পমেয়াদের প্রকল্প বেশি হওয়ার কারণে এটি কমানোর সুযোগ ছিল। আমার পরামর্শ থাকবে এডিপিতে প্রকল্পের সংখ্যাটা কমানোর, যাতে মন্ত্রণালয়গুলো উচ্চ অগ্রাধিকার থাকা কাজগুলো করতে পারে।’


স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া গত মাসে নিজেই জানিয়েছিলেন, নাগরিকদের কাছ থেকে তার মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধেই সবচেয়ে বেশি ঘুস-দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ পেয়েছেন। দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল তার সাবেক সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মো. মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধেও। 



 

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার, ‘পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, ‘সংশোধিত এডিপিতে আমাদের প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকার বাজেট কমানো হয়েছে। যেসব প্রকল্প রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল, সেগুলো বাতিল করা হয়েছে। তবে বৈদেশিক সহায়তায় সেসব প্রকল্প রয়েছে, সেগুলো পরিবর্তন করতে গেলে ডিপিপি পরিবর্তন করতে দীর্ঘমেয়াদি সময়ের প্রয়োজন হয়। ২০১৭, ২০১৮ কিংবা ২০২০ সালে আমরা অনেকগুলো প্রকল্পে বৈদেশিক সহায়তার কমিটমেন্ট পেয়েছি। সময় চলে যাওয়ার কারণে বৈদেশিক ঋণ কিংবা সহায়তার যে বিষয়গুলো—দেখা যাচ্ছে ঋণের সুদ বাড়তে থাকে, তারপরে পেনাল্টির বিষয় আছে এখানে। তাই বৈদেশিক সহায়তার প্রকল্পে আমরা কোনো পরিবর্তন আনিনি, জিওবির প্রকল্পের যেগুলোয় রাজনৈতিক কম্পোনেন্ট রয়েছে সেগুলো পুনর্বিবেচনা করছি, ডিপিপি সংশোধন করছি। আমাদের প্রায় অর্ধেকের বেশি প্রকল্পে ডিপিপি সংশোধন হয়েছে এবং এ কার্যক্রম চলমান রয়েছে।’


শেয়ার করুন