০২ মে ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ০৫:০৮:১৫ পূর্বাহ্ন
পুঁজিবাজারে ওটিসির ফাঁদ, হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ নেমেছে তলানিতে
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৯-০২-২০২৪
পুঁজিবাজারে ওটিসির ফাঁদ, হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ নেমেছে তলানিতে

দেউলিয়াত্বের কারণে পুঁজিবাজার থেকে তালিকাচ্যুত হয়ে ৫৬টি কোম্পানির জায়গা হয়েছে ওভার দ্য কাউন্টার মার্কেটে (ওটিসি)। এসব কোম্পানিতে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন বিনিয়োগকারীরা। তবে এসব শেয়ারধারীদের হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের আর্থিক মূল্যমান কমতে কমতে নেমে এসেছে ৪০০ কোটি টাকার নিচে।


ওটিসির ৫৬টি কোম্পানির মধ্যে ১টি কোম্পানির বিস্তারিত তথ্য নেই। বাকি ৫৫টি কোম্পানির সর্বশেষ লেনদেন হওয়া শেয়ারদর ধরে হিসাব করলেও ৩৯৬ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ আটকে রয়েছে। তবে বিনিয়োগকারীদের এই টাকা ফেরত পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই বললেই চলে। যদিও বিনিয়োগকারীদের মূল বিনিয়োগের পরিমাণ আরও কয়েক গুণ বেশি। কারণ, এসব কোম্পানির অনেকের শেয়ার সর্বশেষ ২ টাকারও কমে লেনদেন হয়েছে। এমন অবস্থায় কোম্পানিগুলোর অবসায়নের পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকেরা।


এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ওটিসির ভবিষ্যৎ দেখি না। উদ্যোক্তারা আগেই শেয়ার বিক্রি করে ফেলেছেন। শেয়ার বিক্রি করে ফেলার পর এসব কোম্পানি জাহান্নামে চলে গেলেই তাঁদের কী আসে যায়? ভোগান্তি সাধারণ বিনিয়োগকারীর। আমি রেগুলেটর বডি হলে উদ্যোক্তাদের শেয়ার বেচতেই দিতাম না।’


এগুলো থেকে বিনিয়োগ ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনাও দেখেন না অধ্যাপক আবু আহমেদ। তিনি বলেন, ‘বিনিয়োগ ফিরে পাওয়ার সুযোগই নেই। শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য ইতিবাচক হলে অবসায়নের মাধ্যমে কিছু ফিরে পাওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু এগুলোর দেনা এত বেশি যে অবসায়ন করলেও কিছুই পাবেন না বিনিয়োগকারীরা।’


এরপরও কোম্পানিগুলোর অবসায়নের পরামর্শ দিয়ে আবু আহমেদ বলেন, এগুলো অবসায়নে যাওয়াই ভালো। এর জন্য পরীক্ষা করতে হবে। দেনা বাদ দিয়ে যদি সম্পদ থাকে, সে ক্ষেত্রে কিছু ফেরত পেতে পারেন বিনিয়োগকারীরা।


সাধারণত দেউলিয়া হয়ে যাওয়া, উৎপাদন বন্ধ, অস্তিত্ববিহীন কোম্পানির শেয়ারগুলোই ওটিসি মার্কেটে লেনদেন হয়। এটা পুঁজিবাজারেরই অংশ। যেসব কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়ে যোগ্যতা ধরে রাখতে পারে না, সেসব কোম্পানি তালিকাচ্যুত হয়ে চলে আসে ওটিসি মার্কেটে। ওটিসিকে অনেকটা পুঁজিবাজারের ডাস্টবিনও বলা চলে।


ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্যমতে, ওটিসি মার্কেটে লেনদেন হওয়া ৫৫টি কোম্পানির সর্বশেষ দর অনুযায়ী উদ্যোক্তা পরিচালক বাদে বিনিয়োগকারীদের টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৯৫ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি, ১৫৩ কোটি ৪০ লাখ ৫২ হাজার টাকার বিনিয়োগ রয়েছে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজে। তবে এই কোম্পানিতে বিনিয়োগের পরিমাণ অন্তত ১০ গুণ বেশি। এভাবে প্রতিটি কোম্পানিরই বিনিয়োগের পরিমাণ আরও কয়েক গুণ বেশি।


সর্বশেষ দর অনুযায়ী কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগকারীদের টাকার পরিমাণ হলো আল আমিন কেমিক্যাল ১৭ কোটি ১০ লাখ, আলফা টোব্যাকো ৩ কোটি ৮৯ লাখ, আমান সি ফুড ৭৬ লাখ, আরবি টেক্সটাইল ২৩ লাখ, আশরাফ টেক্সটাইল ৮ কোটি ৪০ লাখ, আজাদী প্রিন্টার্স ১০ লাখ, বাংলা প্রোসেস ৪ কোটি ২৭ লাখ, বাংলা কেমিক্যাল ১ কোটি ১৭ লাখ, বাংলাদেশ ডায়িং ১ কোটি ৬০ লাখ, বাংলাদেশ হোটেল ৪৬ লাখ, বাংলাদেশ লাগেজ ১ কোটি ৪০ লাখ, বাংলাদেশ প্ল্যানটেশন ৬৯ লাখ, বাংলাদেশ জিপার ৯৮ লাখ, বাংলাদেশ ইলেকট্রিসিটি মিটার ১ কোটি ৬৬ লাখ, বেঙ্গল ফাইন সিরামিকস ২ কোটি ৭৪ লাখ, বায়োনিক সি ফুড ১ কোটি ৫ লাখ, বাংলাদেশ লিফ টোব্যাকো ১ কোটি ৭ লাখ, চিক টেক্স ১ কোটি ৯৮ লাখ, ড্যান্ডি ডাইং ১ কোটি ৭৯ লাখ, ঢাকা ফিশারিজ ৩ কোটি ৫১ লাখ, ডাইনামিক টেক্সটাইল ৯ কোটি ৯১ লাখ, ঈগল স্টার টেক্সটাইল ১ কোটি ৫৫ লাখ, দি ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড ১০ লাখ, এক্সেলশিওর শুজ ৩৭ কোটি ১০ লাখ, গচিহাটা অ্যাকুয়াকালচার ফার্মস ১৫ কোটি ৩৪ লাখ, জার্মান বাংলা জে ভি ফুড ৯০ লাখ, গালফ ফুডস ২ কোটি ৭১ লাখ, হিল প্ল্যান্টেশন ৩৯ লাখ, যশোর সিমেন্ট ১৩ কোটি ২০ লাখ, লেক্সো লিমিটেড ৪ কোটি ৯৮ লাখ, ম্যাক এন্টারপ্রাইজ ৪ কোটি ৮৬ লাখ, ম্যাক পেপার ইন্ডাস্ট্রিজ ৯ কোটি ৫১ লাখ, মেঘনা শ্রিম্প কালচার ১০ কোটি ২৭ লাখ, মেটালেক্স করপোরেশন ৩০ লাখ, এম হোসাইন গার্মেন্টস ওয়াশিং অ্যান্ড ডাইং ৯২ লাখ, মিতা টেক্সটাইল ৮ কোটি ১১ লাখ, মডার্ন সিমেন্ট ৬ কোটি, মডার্ন ইন্ডাস্ট্রিজ ৩৩ লাখ, মোনা ফুড প্রোডাক্টস ১ কোটি ২৪ লাখ, পারফিউম কেমিক্যাল ১৮ কোটি ৮ লাখ, পেট্রো সিনথেটিক ১৬ লাখ, ফার্মাকো ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড ১ কোটি ৬৫ লাখ, ফনিক্স লেদার কমপ্লেক্স লিমিটেড ১ কোটি ৯৯ লাখ, কাশেম সিল্ক মিলস ৫৯ লাখ, কাশেম টেক্সটাইল মিলস ৫৭ লাখ, রহমান কেমিক্যালস ৯ কোটি ২৩ লাখ, রাঙ্গামাটি ফুড প্রোডাক্টস ২ কোটি ৯৯ লাখ, রাশপিত বিডি ১ কোটি ৪৯ লাখ, রাশপিত ডাটা ম্যানেজমেন্ট ৮৭ লাখ, রোজ হ্যাভেন বলপেন ৭ কোটি ৬৭ লাখ, সালেহ কার্পেট মিলস ৩ কোটি ৯৪ লাখ, শ্রীপুর টেক্সটাইল ৬ কোটি ৩০ লাখ, থেরাপিউটিকস (বাংলাদেশ) লিমিটেড ৩ কোটি ৩০ লাখ এবং টিউলিপ ডেইরি অ্যান্ড ফুড ৩২ লাখ ৯০ হাজার টাকার বেশি। এ ছাড়া ডিএসইতে কোনো তথ্য মেলেনি কুয়েস্ট বিডিসি লিমিটেডের।


ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের বিনিয়োগকারী মুবিনুল ইসলাম বলেন, ‘কমিশন রহিমা ফুডের মতো কোম্পানিকে ওটিসি থেকে মূল মার্কেটে এনেছে। আর আমাদের কথা চিন্তা না করেই ইউনাইটেড এয়ারকে তালিকাচ্যুত করেছে। মূল মার্কেটে থাকলে কিছুটা হলেও সুশাসনে থাকত। কিন্তু এখন অনিয়ম করা আরও সহজ হলো।’


এস এম জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘কোম্পানিটি বিমান আকাশে উড়বে এমন টোপ (ফাঁদ) দিয়ে একের পর এক বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। ভালো হবে ভেবে আমি নতুন করে বিনিয়োগ করেছিলাম। এখন পথে বসেছি। বিনিয়োগের টাকা তো কোনোভাবেই ফেরত পাওয়া সম্ভব নয়। এই শেয়ারের কোনো ক্রেতা নেই। কোম্পানির অস্তিত্বই যখন নেই, ক্রেতা আসবে কোথায় থেকে?’


এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম বলেন, ‘ওটিসি মার্কেট থাকবে না। এটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসইসি। ওটিসির কোম্পানি এটিবিতে (অল্টারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ড) যাবে। ওটিসি মার্কেট করা হয়েছিল, যাতে করে বিনিয়োগকারীরাও শেয়ার বিক্রি করে কোম্পানি থেকে বের হতে পারেন।’


কোম্পানিগুলো অবসায়ন না করে এ রকম প্ল্যাটফর্মে রাখার কোনো প্রয়োজন আছে কি? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা থাকলে সমস্যা কী? শেয়ারহোল্ডারদের জন্য কোনো প্ল্যাটফর্মই না থাকা ভালো, নাকি বিক্রির সুযোগ রাখা ভালো?’


শেয়ার করুন