২৮ এপ্রিল ২০২৪, রবিবার, ০৩:৫৯:১৪ পূর্বাহ্ন
হাসপাতালে কত অপমৃত্যু!
  • আপডেট করা হয়েছে : ২২-০২-২০২৪
হাসপাতালে কত অপমৃত্যু!

এবার খতনা করাতে গিয়ে আরও এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। তার নাম আহনাফ তাহমিদ (১০)। ফুল অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার পর এ শিশুটিরও জ্ঞান ফেরেনি। এ ঘটনায় রাজধানীর মালিবাগের জেএস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টার ও হাসপাতালের দুই চিকিৎসককে গ্রেফতার করা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বন্ধ করে দিয়েছে হাসপাতালটি।


দেশের পাঁচতারকা মানের হোটেলসদৃশ হাসপাতালগুলোয় এ ধরনের অপমৃত্যু যেন থামছেই না। এসব ঘটনা আদালত পর্যন্ত গড়ালেও অভিযুক্ত ও তদারকি প্রতিষ্ঠানের চাপে সমাধানও মিলছে না। নামিদামি হাসপাতালে ছোটখাটো সমস্যার চিকিৎসা নিতে গিয়ে অপমৃত্যু অভিভাবক ও সাধারণ মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে। তাদের প্রশ্ন-ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর মিছিল আর কত বড় হলে রাষ্ট্রের টনক নড়বে। এসব ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সেজন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করছে ভুক্তভোগী পরিবার।


বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নামিদামি হাসপাতালগুলোয় একের পর এক রোগীর অপমৃত্যু হলেও কেউ দায় নিচ্ছে না। এতে দেশের স্বাস্থ্য খাত ও চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে রোগী এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এজন্য দায়ী প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি, তদারককারী দপ্তর যেমন : স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলকে (বিএমডিসি) জবাবদিহির মধ্যে আনতে হবে। দ্রুততার সঙ্গে চিকিৎসাসেবা আইন পাশ করতে হবে।


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ইউনাইটেড হাসপাতালে শিশু আয়ান, ল্যাবএইডে যুবক রাহিব এবং সবশেষ জেএস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টার ও হাসপাতালে মারা যাওয়া আহনাফের ওপর ভুল অ্যানেসথেসিয়া প্রয়োগে মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। 


অন্যদিকে চিকিৎসক, হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে মৃত্যুর জন্য অন্যান্য সমস্যার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু হলে কোনোভাবেই দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। কোনো রোগীর অস্ত্রোপচারের আগে সঠিক অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার প্রস্তুতি কেন থাকবে না-এজন্য সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহির মধ্যে আনতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বিএমডিসি-কেউ দায় এড়াতে পারে না। ঘাটতিগুলো কোথায়, খুঁজে দেখতে হবে। 


মালিবাগের জেএস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টার ও হাসপাতালে মঙ্গলবার সুন্নতে খতনা করাতে গিয়ে আহনাফ তাহমিদ (১০) মারা যায়। এর একদিন আগে সোমবার ধানমন্ডির ল্যাবএইড হাসপাতালে এন্ডোসকপি করাতে গিয়ে রাহিব রেজা (৩১) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়। এরও আগে ৭ জানুয়ারি বাড্ডার ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালে খতনা করাতে গিয়ে শিশু আয়ানের মৃত্যু হয়।


মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী আহনাফ তাহমিদের মৃত্যুর ঘটনায় বাবা ফখরুল আলম বাদী হয়ে রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় মামলা করেন। মামলায় তিনজনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ৩-৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। 


এ ঘটনায় গ্রেফতার দুই চিকিৎসককে জেলগেটে দুদিনের জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। বুধবার তাদের আদালতে হাজির করে রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হাতিরঝিল থানার উপপরিদর্শক রুহুল আমিন। শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রাজেশ চৌধুরীর আদালত এ আদেশ দেন। আসামিরা হলেন জেএস হাসপাতালের পরিচালক চিকিৎসক এসএম মুক্তাদির ও চিকিৎসক মাহাবুব মোরশেদ।


জানতে চাইলে আহনাফের বাবা ফখরুল আলম বলেন, তিনি স্ত্রীকে নিয়ে মঙ্গলবার রাত পৌনে ৮টায় ছেলের খতনা করানোর জন্য হাসপাতালে যান। ছেলেকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়ার সময় চিকিৎসকরা জানান, ২০ থেকে ২৫ মিনিট সময় লাগবে। তখন তারা স্বামী-স্ত্রী বাইরে অপেক্ষা করতে থাকেন। ৩০ থেকে ৩৫ মিনিট পর অস্ত্রোপচার কক্ষের দরজায় নক করলে জানানো হয় আরও কিছুক্ষণ সময় লাগবে। এক ঘণ্টা অতিবাহিত হওয়ার পর তিনি (ফখরুল আলম) অপারেশন থিয়েটারে প্রবেশ করতে চাইলে ভেতর থেকে নিষেধ করা হয়। অপেক্ষা করতে বলা হয়।


ফখরুল আলম জানান, একপর্যায়ে তাদের সন্দেহ হলে তিনি জোর করে অস্ত্রোপচার কক্ষে প্রবেশ করেন। সেখানে দেখতে পান ছেলে অচেতন অবস্থায় পড়ে রয়েছে। তার বুকে হাত দিয়ে চাপাচাপি করছে। ছেলের নাকে ও মুখে নল দিয়ে রক্ত বের হওয়া অবস্থা রয়েছে। তখন চিকিৎসক এসএম মুক্তাদিরকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি সঠিক উত্তর দেননি। 


ছেলের এ অবস্থা দেখে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য অন্য হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইলে তারা কর্ণপাত না করে নিজেরাই ছেলের দেহে, বুকে চাপাচাপি, হাত-পা মালিশ করতে থাকে। তখন জোর করে তাকে (ফখরুল আলম) অস্ত্রোপচার কক্ষ থেকে বের করে দেওয়া হয়। দুই ঘণ্টা অতিবাহিত হলেও ছেলের বর্তমান শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে সঠিক তথ্য না দিয়ে কালক্ষেপণ করতে থাকেন। পরে জোর করে অস্ত্রোপচার কক্ষে ঢুকে ফখরুল জানতে পারেন তার ছেলে আহনাফ মারা গেছে।


এদিকে গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর পাঁচ বছর বয়সি আয়ানকে খতনা করানোর জন্য তার পরিবার বাড্ডার ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালে নিয়ে গেলে অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার পর শিশুটির আর জ্ঞান ফেরেনি। পরে তাকে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। ৭ জানুয়ারি সেখানেই মৃত্যু হয় শিশুটির। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। ২৯ জানুয়ারি এ মামলার শুনানিকালে আয়ানের মৃত্যুর ঘটনায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তদন্ত কমিটির রিপোর্টকে ‘আইওয়াশ’ ও ‘হাস্যকর’ বলে মন্তব্য করেন আদালত। 


শেয়ার করুন