২৮ এপ্রিল ২০২৪, রবিবার, ০৪:০৭:৩৭ অপরাহ্ন
সরকারের ফাঁদে পা দেয়নি বিএনপি
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৮-০২-২০২৪
সরকারের ফাঁদে পা দেয়নি বিএনপি

সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনসহ নানা দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে বিএনপি। এখনো দলটি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি।


এর মধ্যে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে একে একে কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পাচ্ছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা। কেউ সাড়ে তিন মাস, আবার কেউ চার মাসেরও বেশি কারাভোগের পর বের হয়েছেন।


গত কয়েক দিনে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ অন্তত ১২ জন কেন্দ্রীয় নেতা মুক্তি পেয়েছেন।


সদ্য কারামুক্ত ৫ জন কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে জেলজীবনসহ নানা বিষয়ে কথা হয় যুগান্তরের সঙ্গে। তারা জানান, নানা নির্যাতনের মধ্যেও সরকারের ফাঁদে পা দেয়নি বিএনপি। তাদের কেউ বলছেন, কারাগারে থাকা অবস্থায় নানা ধরনের প্রলোভন ও সমঝোতার প্রস্তাব পেয়ে তারা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন। আবার এ ধরনের প্রস্তাবের বিষয়ে কোনো কিছুই জানেন না বলে মন্তব্য করেছেন অন্য নেতারা।


কারামুক্ত নেতারা আরও জানান, তারা রাজনীতি করেন আদর্শের ভিত্তিতে। দেশের গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্যই তাদের চলমান আন্দোলন। সবাইকে সম্পৃক্ত করে আবারও নতুন পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামবে বিএনপি।


জেলজীবন নিয়ে প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, জেলজীবন কারও জন্য ভালো হতে পারে না। রিমান্ডে মানসিকভাবে নির্যাতন করেছে, কিন্তু মনোবল ভাঙতে পারেনি। দেশের গণতন্ত্র ও জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলন করতে গিয়ে মিথ্যা মামলায় তাদের জেলে যেতে হয়েছে। এটা সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণাদায়ক। মিথ্যা-গায়েবি মামলা দিয়ে হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এই অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করে জেলে কাটাতে হয়েছে।


গত বছরের জুলাইয়ে এক দফা আন্দোলনের দাবি রাজপথে নামে বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দল ও জোট। ২৮ অক্টোবরে ঢাকায় মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর রাজনীতির গতিপথ পালটে যায়। দলটির মহাসচিবসহ সারা দেশের প্রায় ২৬ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়।


হরতাল, অবরোধ, অসহযোগ, গণসংযোগ কর্মসূচির মধ্যেই ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপিসহ বেশিরভাগ বিরোধী রাজনৈতিক দল। টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ।


প্রায় সাড়ে তিন মাস কারাভোগের পর গত বৃহস্পতিবার জামিনে মুক্ত হন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী। জেলজীবন কেমন ছিল? এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক এই বাণিজ্যমন্ত্রী যুগান্তরকে বলেন, ‘জেল তো জেলই। জেলজীবন কারও জন্য ভালো হতে পারে না। সবচেয়ে বড় দুঃখের বিষয় হচ্ছে দেশের গণতন্ত্র ও জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলন করতে গিয়ে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে ও মিথ্যা মামলায় জেলে যেতে হয়েছে। এটা সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণাদায়ক।’


কারাবাসের অভিজ্ঞতা শুনতে শুনতে উঠে আসে ‘ভোটে অংশ নিলে এক রাতে বিএনপি নেতাদের মুক্তি দেওয়া হবে’-সাবেক কৃষিমন্ত্রীর এমন বক্তব্য প্রসঙ্গে আমির খসরু বলেন, ‘এমন কিছু আমাদের জানা নেই। আমার জানা মতে এমন প্রস্তাবের বিষয়ে বিএনপির কেউ জানেন না। তবে নির্বাচনে যাওয়া রাজনৈতিক, গণতান্ত্রিক ও জনগণের অধিকার। এখানে কেউ কাউকে বিপাকে ফেলে কিংবা জেলে পাঠিয়ে, মুক্তি দেওয়ার বিষয়ে যেসব আলোচনা এটা লজ্জাজনক। যেসব দল ও রাজনীতিবিদ এসব চিন্তা করেন তাদের গণতন্ত্রের বিন্দুমাত্র জ্ঞান আছে বলে আমি মনে করি না।’


আমির খসরু বলেন, ৭ জানুয়ারির নির্বাচন বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব দেখেছে। এটা কেউ গ্রহণ করেনি। জনগণের ভোটাধিকার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে।


একদফা আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘একদফা নিয়ে সারা দেশের মানুষ আশাবাদী। এটা শুধু আমার কিংবা বিএনপির বিষয় না, জনগণের ভোটাধিকার, রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পাওয়ার বিষয়। তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে সরকার গঠন হবে। এর ব্যতিক্রম হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এই দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের সংবিধানের প্রতি আমাদের অবজ্ঞা করা হবে। স্বাধীনতার যুদ্ধের প্রতি অবজ্ঞা করা হবে। সুতরাং একটা স্বাধীন দেশের জন্য একদফা দাবি আমাদের বাস্তবায়ন করতে হবে। ’


তিন মাস ৬ দিন কারাভোগের পর মুক্তি পাওয়া বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মজিবুর রহমান সরোয়ার বলেন, ‘আমি অসুস্থ ছিলাম। কারাগারে ভালো চিকিৎসা পাইনি।’


বিএনপি ভাঙার প্রস্তাব পেয়েছেন কি না-এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি যে প্রস্তাব পাইনি তা নয়। আমি বলেছি এই মুহূর্তে গণতন্ত্র দরকার, নির্বাচন নয়। দেশের গণতন্ত্র ঠিক থাকলে নির্বাচন করা উচিত হবে। কিন্তু তারা তো সংলাপেই বসল না। তারা আমেরিকাকে দায়ী করে রাশিয়া ও চায়নার সমর্থন নেওয়ার চেষ্টা করেছে। ভূ-রাজনৈতিক কারণে আমাদের এখানে সমস্যা কঠিন হয়েছে।’


তিন মাস ৫ দিন পর মুক্তি পেয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স।


তিনি বলেন, ‘মানসিক নির্যাতনের মধ্যেই কারাগারে সময়গুলো কেটেছে। বিভিন্ন চাপের মধ্যে ছিলাম। কারাগার তো আর স্বাভাবিক জীবন না। আমাদের অনেকেই সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সঠিক চিকিৎসা পায়নি ঠিকমতো। সাধারণ নেতাকর্মীরা সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থায় ছিল। রিমান্ডে তাদের ওপর শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। কেউ কেউ জেলখানাতেও নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছে। সঠিক চিকিৎসা না পাওয়ার কারণে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। নেতাদের ‘পিসি (প্রিজনারস ক্যান্টিন বা বন্দিদের ব্যক্তিগত তহবিল) যে টাকা দেওয়া হয়েছে, তাও তাদের দেওয়া হয়নি। খাওয়া-দাওয়ার মধ্যেও অনেক কষ্ট ছিল। জেল কোড অনুযায়ী যা প্রাপ্য সেগুলোও দেওয়া হয়নি।’


সাবেক কৃষিমন্ত্রীর বক্তব্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদেরকে নির্বাচনে নেওয়ার জন্য একটা প্রস্তাব বিভিন্নভাবে দেওয়া হয়েছিল এবং ভোট যাওয়ার জন্য বলা হয়েছিল। এসব আমরা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছি।’


তিনি বলেন, যারা মুক্তি পেয়েছে তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারছে না। এমন একটা পরিস্থিতিতেও দল একদফার আন্দোলন থেকে বিচ্যুত হয়নি। অবশ্যই একদফা দাবি আদায় বাস্তবায়ন হবে।


চার মাস ৪ দিন কারাভোগের পর মুক্তি পেয়েছেন বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি। তিনি বলেন, ‘কারাগারে ভালো থাকার সুযোগ নেই। আমরা সবাই তো নির্যাতিত। মিথ্যা-গায়েবি মামলা দিয়ে হাজার-হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এই অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করে আমাদের জেল কাটতে হয়েছে।’


সাবেক কৃষিমন্ত্রীর বক্তব্য প্রসঙ্গে এ্যানি বলেন, ‘এরা (আ.লীগ সরকার) তো যা করেছে সব ওপেনে করেছে। লুকিয়ে করেনি। আর প্রস্তাব দেওয়া-নেওয়ার মধ্যে আমাদের রাজনীতি সীমাবদ্ধ ছিল না। আমরা রাজনীতি করছি আদর্শের ভিত্তিতে। দেশের গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্যই আমাদের সংগ্রাম ছিল। এ ধরনের কথা আমরা সবসময় ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছি।’


শেয়ার করুন