০৬ মে ২০২৪, সোমবার, ০৪:৪৫:৪৩ পূর্বাহ্ন
ইটভাটার দাপটে অসহায় নদী বসতি বিদ্যালয়
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৯-১১-২০২৩
ইটভাটার দাপটে অসহায় নদী বসতি বিদ্যালয়

গাজীপুরের শ্রীপুরে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে জনবসতি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশে গড়ে উঠেছে সারি সারি ইটভাটা। আইনের তোয়াক্কা না করে রাজনৈতিক পরিচয়ে এসব অবৈধ ইটভাটা চালাচ্ছেন মালিকেরা। বাড়ছে পরিবেশদূষণ। স্থানীয় জনগোষ্ঠী এবং বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কষ্ট পাচ্ছে। তবে ইটভাটার মালিকেরা প্রভাবশালী হওয়ায় প্রতিবাদ করার সাহস পান না এলাকাবাসী। পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযানও কোনো কাজে আসছে না।


উপজেলা প্রশাসন সূত্র বলেছে, শ্রীপুর উপজেলায় ২০২১ সালে ইটভাটা ছিল ২২টি। বর্তমানে আছে ১৬টি। এর মধ্যে বৈধ ইটভাটা 

মাত্র একটি।


এক গ্রামেই ১১ ইটভাটা

শ্রীপুর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি ইটভাটা রয়েছে গোসিংগা ইউনিয়নের লতিফপুর গ্রামে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে। সেখানে সারিবদ্ধভাবে ১১টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে চারটি ইটভাটা আপাতত বন্ধ। সম্প্রতি সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ইটভাটাগুলোর একপাশে শীতলক্ষ্যা নদী। আরেক পাশে চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এগুলো হলো লতিফপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, লতিফপুর উচ্চবিদ্যালয়, লতিফপুর আশরাফুল উলুম আলিম মাদ্রাসা এবং লতিফপুর কিন্ডারগার্টেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ৫০০ মিটারের মধ্যেই কমপক্ষে একটি করে ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে লতিফপুর উচ্চবিদ্যালয় থেকে ২০ মিটার দূরে এলবিএম ব্রিকস।


নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক স্কুলশিক্ষক বলেন, ‘এই চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শত শত শিক্ষার্থী পড়ছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দুর্বলতার কারণে আইনের তোয়াক্কা না করেই এসব ইটভাটা গড়ে উঠেছে। আমরা অনেক অভিযোগ করেছি, কোনো কাজ হয় না। এলাকাবাসী ভয়ে প্রতিবাদও করে না।’ 


এ নিয়ে কথা হয় লতিফপুর উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী তামান্না আক্তারের সঙ্গে। সে জানায়, ইটভাটার কালো ধোঁয়া ভেসে আসে স্কুলেও। অনেক সময় খুব খারাপ লাগে। 


ইটভাটার মালিকেরা রাজনীতিতে জড়িত

শ্রীপুরের ইটভাটাগুলোর প্রায় প্রত্যেক মালিকের রাজনৈতিক পরিচয় রয়েছে। কেউ সরাসরি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, কেউ সমর্থক। প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র বলেছে, লতিফপুরে এলবিএম ব্রিকসের মালিক প্রয়াত মো. খোকা মিয়া ছিলেন গোসিংগা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি। খোকা মিয়ার মৃত্যুর পর সেই রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ভাটা পরিচালনা করছেন তাঁর ছেলে শহিদুল্লাহ। এলবিএম-২ ব্রিকসের মালিক মো. লিয়াকত আলী শেখ গোসিংগা ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতা। এবিএম ব্রিকসের মালিক গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. হান্নান মিয়া (হান্নু)। এ ছাড়া বরমী ইউনিয়নের বরকুল গ্রামের হুমাইরা ব্রিকসের মালিক মো. সোহেল রানা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটিতে রয়েছেন।


এ প্রসঙ্গে লতিফপুর আশরাফুল উলুম আলিম মাদ্রাসার এক শিক্ষক বলেন, ‘আমরা ইটভাটার ধোঁয়ায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি। প্রতিবাদ করলে কী হবে? অনেক সময় প্রশাসনের লোকজন আসে সমস্যার কথা জানতে। কিন্তু স্থায়ী কোনো সমাধান হয় না।’


লতিফপুরের মেসার্স মদিনা ব্রিকস উপজেলার একমাত্র বৈধ ইটভাটা। এর মালিক মো. মোশাররফ হোসেন। তিনিও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত এবং গাজীপুর জেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আসলে নিয়মনীতি, আইন অনুযায়ী একটি ইটভাটাও পরিচালনা করা সম্ভব নয়। আমরা পরিবেশের ছাড়পত্র পেতে পর্যায়ক্রমে সবাই চেষ্টা করছি। কোনো কোনো ভাটার পরিবেশের ছাড়পত্র নবায়ন হয়েছে। আবার কোনো কোনোটির ছাড়পত্র নবায়ন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’


এ প্রসঙ্গে শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তরিকুল ইসলাম বলেন, জেলা প্রশাসকের নির্দেশনায় ইতিমধ্যে উপজেলার সব ইটভাটা মালিককে ডেকে তাঁদের কাগজপত্র চাওয়া হয়েছে। অবৈধ ইটভাটাগুলো স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ইতিমধ্যে গত এক বছরে প্রশাসনের কঠোর নজরদারি থাকায় অনেক ইটভাটা বন্ধ হয়েছে। 


অভিযান হয়, বন্ধ হয় না ইটভাটা

অবৈধ ইটভাটা বন্ধে মাঝেমধ্যেই অভিযান পরিচালনা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। তবে কিছুদিন না যেতেই এসব ভাটা আবার চালু হয়। গত বছরের ২৯ নভেম্বর পরিবেশ অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে পাঁচটি ইটভাটাকে জরিমানা করে। এগুলো হলো লতিফপুর গ্রামের মেসার্স কেবিএম ব্রিকস, মেসার্স এলবিএম ব্রিকস, মেসার্স এলবিএম ব্রিকস-২, মেসার্স এবিএম ব্রিকস এবং মেসার্স মদিনা ব্রিকস। ইটভাটাগুলো আবারও চালু করা হয়েছে। এর মধ্যে মেসার্স মদিনা ব্রিকস পরে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি পেয়েছে। বাকি ইটভাটাগুলো অনুমোদনহীনভাবেই চলছে।


এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. নয়ন মিয়া আজকের পত্রিকাকে বলেন, কোনো অবৈধ ইটভাটা চলতে দেওয়া হবে না। একদম ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে। ইতিমধ্যে অনেক অবৈধ ইটভাটা স্থায়ীভাবে বন্ধ করা হয়েছে।


শেয়ার করুন