২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ১১:০৮:০৪ অপরাহ্ন
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: কথায় কথায় ছাত্রলীগের তালা
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৯-০৮-২০২৩
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: কথায় কথায় ছাত্রলীগের তালা

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শহীদ আবদুর রব হলের পার্কিংয়ের জায়গায় গত শুক্রবার রাতে মোটরসাইকেল রাখেন শাখা ছাত্রলীগের উপগ্রুপ ‘বাংলার মুখ’-এর কর্মী হৃদয় প্রামাণিক। পরদিন শনিবার সকালে তিনি সেখানে গিয়ে দেখেন, মোটরসাইকেলটি নেই। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকে তালা দিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন বাংলার মুখের নেতা-কর্মীরা। টানা দুই ঘণ্টা মূল ফটক আটকে রাখেন তাঁরা। এ সময় এক শিক্ষকের অ্যাম্বুলেন্সকেও বাইরে যেতে দেওয়া হয়নি।


শুধু গত শনিবারের ওই ঘটনা নয়, পান থেকে চুন খসলেই ফটকে তালা দেওয়া যেন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। গ্রুপিং ঝামেলা, নতুন কমিটি গঠন, প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগ দাবিসহ বিভিন্ন ঠুনকো কারণে চলতি মাসেই পাঁচবার ফটকে তালা ঝুলিয়েছেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। আর গত দুই বছরে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে অন্তত ২০ বার।


সর্বশেষ গতকাল সোমবার সোহরাওয়ার্দী হলে তালা দেয় শাখা ছাত্রলীগের বিজয় গ্রুপের একাংশ। এর আগে গত বৃহস্পতিবার  প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগের দাবিতে আলাওল হলের ফটকে তালা দিয়ে বিক্ষোভ করেন বিজয় গ্রুপের অন্য অংশের নেতা-কর্মীরা।


শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মচারীরা বলছেন, কথায় কথায় ফটকে তালা দেওয়ার এসব ঘটনায় ব্যাহত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম। বন্ধ হয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শহরে বাস চলাচল। এতে অনেক সময় ক্যাম্পাসে বন্দী হয়ে পড়েন অনাবাসিক শিক্ষার্থীরা।


ভোগান্তিতে পড়েন ক্যাম্পাসের ভেতরে বাস করা শিক্ষার্থীসহ শিক্ষক-কর্মচারী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা। এসব ঘটনায় ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরে থাক, অনেক সময় তালা দেওয়ার কয়েক ঘণ্টায়ও ঘটনাস্থলে দেখা যায় না প্রক্টরিয়াল বডিকে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকেও জড়িতদের বিরুদ্ধে গত এক বছরে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।


প্রশাসনের চরম ব্যর্থতার কারণে তালা দেওয়ার ঘটনা বারবার ঘটছে বলে মনে করছেন চবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আবদুল হক। তিনি বলেন, তাঁরা এই বিষয়গুলোকে আইনানুগভাবে অথবা যথোপযুক্তভাবে সামাল দিতে পারছেন না।


বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য ড. নঈম উদ্দিন হাছান আওরঙ্গজেব চৌধুরী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘তালা দেওয়ার পর অ্যাম্বুলেন্স আটকে দেওয়ার ঘটনা শুনেছি। এটা অত্যন্ত নিন্দনীয় ও গর্হিত কাজ। কারণে-অকারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটক বন্ধ করার ঘটনা বন্ধে বিশ্ববিদ্যালয় যাতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে, সেটাই কাম্য।’


ফটকে তালা ঝুলিয়ে বিভিন্ন সময় অস্থিরতা তৈরির পেছনে মূল কারণ ক্যাম্পাসে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের বেপরোয়াপনা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে দুটি গ্রুপে বিভক্ত। প্রতিটি গ্রুপের আবার রয়েছে বিভিন্ন উপগ্রুপ। এর মধ্যে একটি গ্রুপের নেতা-কর্মীরা নিজেদের শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী হিসেবে পরিচয় দেন।


অন্য গ্রুপের নেতা-কর্মীরা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী। এই দুই গ্রুপ আবার ১১টি উপগ্রুপে বিভক্ত। আ জ ম নাছিরের অনুসারী উপগ্রুপগুলো হলো একাকার, কনকর্ড,  রেড সিগন্যাল, উল্কা, বাংলার মুখ, সিক্সটি নাইন, এপিটাফ, ভার্সিটি এক্সপ্রেস (ভিএক্স), ও সংগ্রাম (মেয়েদের)। নওফেলের অনুসারীদের উপগ্রুপ দুটি হলো বিজয় ও সিএফসি।  


চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নিয়ন্ত্রণ থাকাকালীন শাটল ট্রেনের বিভিন্ন বগিকে কেন্দ্র করে গ্রুপগুলো গড়ে ওঠে। পরবর্তী সময়ে শিবির ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত হলেও এখন নিজেরাই প্রতিনিয়ত সংঘর্ষে জড়াচ্ছে ছাত্রলীগের এই গ্রুপগুলো। যখন-তখন দিচ্ছে ফটকে তালা।


তালা দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি ও বাংলার মুখের নেতা আবু বকর তোহা আজকের পত্রিকাকে বলেন, প্রশাসনের কাছে কোনো একটা দাবি বা সমস্যা নিয়ে গেলে তারা অনেক সময় আন্তরিকভাবে বিষয়টা দেখে না। ফলে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ফটকে তালা দেওয়ার ঘটনা ঘটে।


শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন টিপু বলেন, যে সংগঠনই করুক না কেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ ঠিক রাখার জন্য তালা দেওয়ার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যেকোনো দাবিদাওয়া বা যৌক্তিক ইস্যু থাকলে প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধান করা যেতে পারে।


চার বছরে ১৫৫ বার সংঘর্ষ পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন, হল দখল, আধিপত্য বিস্তার, টেন্ডারের টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারাসহ বিভিন্ন বিরোধে গত চার বছরে অন্তত ১৫৫ বার সংঘর্ষে জড়িয়েছে শাখা ছাত্রলীগের বিভিন্ন গ্রুপ। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন কয়েক শ নেতা-কর্মী। আবার বহিষ্কারও হয়েছেন অর্ধশতাধিক। যদিও বহিষ্কারাদেশ কখনোই পুরোপুরিভাবে বাস্তবায়ন করেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বহিষ্কারের কিছুদিন না যেতেই বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। জানা গেছে, গত দুই বছরে অন্তত দুবার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।


শেয়ার করুন