২৮ এপ্রিল ২০২৪, রবিবার, ০২:৫০:০০ পূর্বাহ্ন
এমটিএফই প্রতারকদের ধরতে মাঠে নেমেছে সিআইডি
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৭-০৮-২০২৩
এমটিএফই প্রতারকদের ধরতে মাঠে নেমেছে সিআইডি

বিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নেওয়ার পর টনক নড়েছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর। রাতারাতি কোটিপতি বানানোর প্রলোভনে যেভাবে লাখ লাখ লোককে ফতুর করে অনলাইন দুনিয়ায় শীর্ষ প্রতারক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে এমটিএফই- তাতে বিস্ময় প্রকাশ করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সিআইডি সাইবার ইন্টেলিজেন্স টিম এ বিষয়ে গভীর নজরদারি শুরু করেছে। ভুক্তভোগী ও প্রতারিত গ্রাহকদের এ প্রতারক চক্র সম্পর্কে তথ্য দিয়ে বা অভিযোগ জানাতে সিআইডি সাইবার সাপোর্ট সেন্টারে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে সারাদেশে গোয়েন্দা জাল ছড়িয়ে সাঁড়াশি অভিযানের মতো অ্যাকশন শুরু করেছে এই সংস্থা।


সিআইডির জনসংযোগ কর্মকর্তা এডিশনাল এসপি আজাদ রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, এমটিএফই’র নেপথ্য খলনায়কদের ধরার জন্য ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। এখন মাঠ পর্যায়ে অ্যাকশন শুরু হয়ে গেছে। প্রাথমিক অনুসন্ধানে কমপক্ষে দুই লাখ ভিকটিমের তথ্য মিলেছে। অন্যদিকে দুবাইভিত্তিক ওই অনলাইন প্রতারণায় জড়িত দুই শতাধিককে চিহ্নিত করা হয়েছে। এখন দেশীয় প্রতারকদের ধরার চেষ্টা চলছে। যে কোনো সময় তারা ধরা পড়ে যাবে। পাশাপাশি দুবাইসহ অন্য দেশে যারা জড়িত রয়েছে, তাদেরও চিহ্নিত করা গেছে।


তিনি জানিয়েছেন, প্রতারকদের চিহ্নিত ও প্রতারিতদের সহায়তায় সিআইডি মাঠে নেমেছে। এজন্য অনলাইন বা ভার্চুয়াল দুনিয়ায় ডলার, শেয়ার বা ক্রিপ্টোকারেন্সি কেনাবেচার কানাডা ও দুবাইভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ গ্রুপ ইনকরপোরেটেডে (এমটিএফই) প্রতারিত হওয়া গ্রাহকদের কাছ থেকে তথ্য সহায়তা চাওয়া হয়েছে।



তিনি আরও জানান, শুধু এমটিএফই নয়, দেশে সক্রিয় তবে অনিবন্ধিত মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনভিত্তিক এ ধরনের প্রতারক চক্রের এমএলএম ব্যবসা এবং ক্রিপ্টোকারেন্সিতে লেনদেন অবৈধ ও নিষিদ্ধ।



জানা গেছে, এমটিএফই বিনিয়োগকারীদের উচ্চ মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলায়। বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ক্রিপ্টো ট্রেডিং। এমটিএফইতে ক্রিপ্টো ট্রেডিং করে মুনাফার পাশাপাশি আরেকটি প্রলোভন দেখানো হয়। একজন গ্রাহক যদি নতুন কাউকে এখানে বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করেন, তাহলে তিনি নতুন গ্রাহকের বিনিয়োগকারী। অনলাইন প্লাটফর্মে থাকলেও এমটিএফই নিজেদের কানাডিয়ান কোম্পানি দাবি করে, যার প্রতিষ্ঠাকাল ২০০৫ সালে। তবে বাংলাদেশে এ বছরের জানুয়ারি মাসে তাদের কার্যক্রম পুরোদমে শুরু হয়। এমটিএফইর বিরুদ্ধে কানাডিয়ান সিকিউরিটিজ অ্যাডমিনিস্ট্রেটরসের (সিএসএ) কাছে প্রতারণার বেশ কয়েকটি অভিযোগও রয়েছে।


এ বিষয়ে সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) আজাদ রহমান জানান, এমটিএফই অ্যাপসের মাধ্যমে গ্রাহকদের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে আহ্বান জানানো হয় এবং লেনদেন পরিচালনা করা হয়। নিজেদের ছায়া  প্ল্যাটফর্মে ট্রেড করার সুযোগ দিয়ে এই অ্যাপ সম্প্রতি আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।



এদিকে সিআইডির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশে কোনো অফিস না থাকলেও চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে এর কার্যক্রম শুরু হয়। ঘরে বসে সহজে আয়ের পথ বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ইউটিউবে ব্যাপক প্রচার চালায়। বিভিন্ন ভিডিও এবং বিজ্ঞাপন দেখে অনেকেই আগ্রহী হন। সবচেয়ে বেশি আগ্রহী হন একজন আরেকজনকে দেখে, এক্ষেত্রে রেফারেল বা মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কাজ করে। এমটিএফইও এমএলএম পদ্ধতিতে কাজ করেছে। বেশি লাভের আশায় লাখ লাখ মানুষ অ্যাপসটিতে বিনিয়োগ করেন। কিছু মানুষ অবশ্য লাভের অংশ পেয়েছে। তবে চূড়ান্ত  বিচারে বিনিয়োগের সব অর্থই খোয়াতে হয় গ্রাহকদের। ঢাকাসহ বরিশাল, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুষ্টিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাজশাহী, কুমিল্লা এবং সাতক্ষীরাতে প্রতারণা সবচেয়ে বেশি হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, সারাদেশে চার থেকে পাঁচ লাখ গ্রাহক এমটিএফইর মাধ্যমে কয়েক হাজার কোটি টাকা খুইয়েছেন।


এ বিষয়ে আজাদ রহমান জানান, গুগল প্লে স্টোর থেকে যে কেউ এমটিএফই অ্যাপটি ডাউনলোড করে রেজিস্ট্রেশন করতে পারতেন। রেজিস্ট্রেশনের পর তাদের নিজস্ব ওয়ালেটে ট্রেড করার জন্য ডলার রাখতে হতো। ডলারের পরিমাণ অনুযায়ী তাদের প্রতিনিয়ত প্রলোভন দিয়ে লাভের কথা বলা হতো। ৫০০ ডলার বিনিয়োগ করলে দিনশেষে পাঁচ হাজার টাকা লাভ হবেÑ এমন কল্পিত মুনাফার কথাও বলা হতো। রেজিস্ট্রেশনের জন্য ব্যাংকের একাউন্ট এবং জাতীয় পরিচয়পত্র জমা দিতে হয়েছে গ্রাহকদের। ভার্চুয়ালি ক্রিপ্টোকারেন্সি ও ডলার কেনাবেচা করা হলেও লভ্যাংশ দেওয়া হতো মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে।


সিআইডির একটি সূত্র জানয়, অনলাইনভিত্তিক এমএলএম কোম্পানি এমটিএফইর ফাঁদে পড়ে লাখ লাখ মানুষ যেমন সর্বস্বান্ত হয়েছে, তেমনি অনেকেই রাতারাতি কোটিপতিও বনে গেছেন। এই অ্যাপের কল্যাণেই হঠাৎ কোটিপতি হয়েছেন ভার্চুয়াল মুদ্রা ক্রিপ্টোকারেন্সির অন্যতম মাস্টারমাইন্ড মো. নুরুন্নবী ওরফে পলাশ। তার বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার চৌডালার কদমতলী গ্রামে। এমটিএফই অ্যাপ উধাওয়ের খবরের মধ্যেই নুরুন্নবী আরেকটি নতুন অ্যাপ জিটিসি-এক্স নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। এমনকি গত ১৭-১৯ আগস্ট জিটিসি-এক্স’র বাংলাদেশ টিমের কয়েকজনের ট্যুর হয়েছে কক্সবাজারে। সেখানে এমটিএফই প্রতারণার চাঁপাইনবাবগঞ্জের অন্যতম হোতা নুরুন্নবীও ছিলেন। সিআইডি প্রাথমিক তদন্তে নিশ্চিত হয়েছে, নুরুন্নবী ক্রিপ্টোকারেন্সি কেনাবেচাসহ মানি লন্ডারিং ও অনলাইন প্রতারণার অন্যতম হোতা। এসবের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ দেশী-বিদেশী মুদ্রা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে তিনি এখন কয়েক কোটি টাকার মালিক।


শেয়ার করুন