০১ মে ২০২৪, বুধবার, ১০:৩৯:২২ অপরাহ্ন
প্রিগোঝিনের মতো রহস্যময় পরিণতি বরণ করেছেন পুতিনের যেসব ‘প্রতিপক্ষ’
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৪-০৮-২০২৩
প্রিগোঝিনের মতো রহস্যময় পরিণতি বরণ করেছেন পুতিনের যেসব ‘প্রতিপক্ষ’

রাশিয়ার ভাড়াটে সেনা সরবরাহকারী সংস্থা ভাগনারের প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোঝিনকে বহনকারী বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে প্রিগোঝিন নিহত হয়েছেন বলে দাবি করেছে রুশ কর্তৃপক্ষ। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের এক সময় বেশ আস্থাভাজন ছিলেন প্রিগোঝিন। কিন্তু চলতি বছরের ২৩ এবং ২৪ জুন রাশিয়ার বিরুদ্ধে এক বিদ্রোহ ঘোষণা করে পুতিনের চক্ষুশূল বনে যান তিনি। তখন পুতিন প্রিগোঝিনকে কিছু না বললেও বিদ্রোহকে ‘গৃহযুদ্ধ’ শুরুর উদ্যোগ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। 


যাই হোক, পুতিন সে সময় প্রিগোঝিনকে ক্ষমা করে দিলেও বিমান দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যুর বিষয়টি অনেক জল্পনা-কল্পনার জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে অনেকে ভাবছেন, হয়তো পুতিনের রোষের কারণেই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাতে হলো। বিষয়টি যদিও স্পষ্ট নয় তবে অমূলকও নয়। কারণ এর আগেও পুতিনের অনেক ‘প্রতিপক্ষই’ অস্বাভাবিকভাবে প্রাণ হারিয়েছেন নয়তো অন্য কোনো মৃত্যুর কাছাকাছি উপনীত করছেন। 


পুতিনের যেসব বিভিন্ন রহস্যময় করুণ পরিণতি বরণ করেছেন তাদের মধ্যে অ্যালেক্সেই নাভালনি, ভ্লাদিমির কারা-মুরজা, আলেক্সান্ডার লিটভিনেঙ্কো, আলেক্সান্ডার পেরিপিলিচনি, ভিক্টর ইউশ্চেঙ্কো এবং অ্যানা পলিতকোভস্কায়া উল্লেখযোগ্য। তাদের পরিণতি সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো। 


অ্যালেক্সেই নাভালনি 

নাভালনি রাশিয়ায় পুতিনবিরোধী অন্যতম পরিচিত মুখ। তিনি ২০২০ সালের আগস্টে জার্মানি যান চিকিৎসার জন্য। যে সময় তিনি দাবি করেছিলেন, তাঁকে রুশ সরকার সাইবেরিয়ায় কারাগারে রেখে তাঁর শরীরে নভিচক বিষ প্রয়োগ করেছে। অবশ্য রুশ সরকার সেই দাবি অস্বীকার করে। 


পরে ২০২১ সালে কোভিডের মধ্যেই নাভালনি রাশিয়ায় ফিরে যান। ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। বর্তমানে নাভালনি রাশিয়ার একটি কারাগারে বন্দী। তাঁর বিরুদ্ধে আনা জালিয়াতিসহ একাধিক অভিযোগে তাঁকে সাড়ে ১১ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি নাভালনিকে আরও ১৯ বছর অতিরিক্ত কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।  

 

ভ্লাদিমির কারা-মুরজা

রাশিয়ার বিরোধী রাজনীতিবিদ এবং অধিকারকর্মী ভ্লাদিমির কারা-মুরজা পুতিনবিরোধী মুখ বলে পরিচিত। তিনি দাবি করেছিলেন, তাঁকে ২০১৫ সালে এবং ২০১৭ সালে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে। পরে অবশ্য জার্মানির একটি গবেষণাগারে কারা-মুরজার শরীরের নমুনায় উচ্চ মাত্রার পারদ, তামা, ম্যাংগানিজ এবং জিংকের উপস্থিতির প্রমাণ পায়। তবে মস্কো এই ঘটনাও নিজেদের সংযোগ অস্বীকার করে। 


সের্গেই স্কৃপাল

সের্গেই স্কৃপাল রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার ডবল এজেন্ট ছিলেন। একপর্যায়ে তিনি রাশিয়ার গোয়েন্দা তথ্য ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থার কাছে পাচার করা শুরু করেন। পরে ২০১৮ সালের মার্চে ব্রিটেনের স্যালিসবারি শহরে একটি শপিং সেন্টারের বাইরে একটি বেঞ্চে স্কৃপাল এবং তাঁর কন্যা ইউলিয়াকে অচেতন অবস্থায় পাওয়া যায়। 

 

আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাদের হাসপাতালে নেওয়া হয়। ব্রিটিশ কর্মকর্তারা জানান, ওই দুজনকেই নভিচক বিষ দেওয়া হয়েছিল। উল্লেখ, সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক বাহিনীর গবেষকেরা ১৯৭০ থেকে ১৯৮০-এর দশকে এই বিষ আবিষ্কার করেন। পরে এই বিষের প্রভাব কাটিয়ে স্কৃপাল এবং ইউলিয়া দুজনেই বেঁচে যান।   


রাশিয়ায় বিমান বিধ্বস্ত, যাত্রীর তালিকায় ভাগনারপ্রধান প্রিগোঝিনরাশিয়ায় বিমান বিধ্বস্ত, যাত্রীর তালিকায় ভাগনারপ্রধান প্রিগোঝিন

আলেক্সান্ডার লিটভিনেঙ্কো

এক সময় রুশ গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি ও দেশটির কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা সংস্থার উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন আলেক্সান্ডার লিটভিনেঙ্কো। পরে এই বাহিনীগুলোর অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবাদ করলে ১৯৯৮ সালে বহিষ্কার করা হয় তাঁকে। রাশিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তখন কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা সংস্থার প্রধান ছিলেন।


এই অবস্থায় লিটভিনেঙ্কোকে চিরতরে সরিয়ে দিতে ২০০৬ সালে কেজিবির দুই গোয়েন্দাকে যুক্তরাজ্যে পাঠান পুতিন। তাঁদেরই একজন ছিলেন আন্দ্রেই লুগোভই। লিটভিনেঙ্কোর সঙ্গে লন্ডনের মিলেনিয়াম হোটেলে সাক্ষাৎ করে তাঁর চায়ের কাপে শক্তিশালী রাসায়নিক অস্ত্র ‘পোলোনিয়াম’ ঢেলে দিয়েছিলেন লুগোভই। মারাত্মক ওই রাসায়নিকের তেজস্ক্রিয়তায় ২৩ দিন ভোগে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন লিটভিনেঙ্কো। তবে মৃত্যুর আগে হাসপাতালের বিছানায় শুয়েই রাসায়নিক হামলার রহস্য উদ্ঘাটন করে গিয়েছিলেন তিনি।


আলেক্সান্ডার পেরিপিলিচনি

রাশিয়া থেকে অর্থ পাচারের একটি মামলায় ২০০৯ সালে সুইজারল্যান্ডের কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করেছিলেন পেরিপিলিচনি। এরপর প্রাণ ভয়ে তিনি ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন তিনি। পরে ব্রিটেনেই নিবাস গড়েন তিনি। তিন বছর পর ২০১২ সালের নভেম্বরের এক সকালে জগিং করার জন্য বের হয়েছিলেন তিনি। সেদিনই তাঁর বাড়ির মূল ফটকের সামনে তাঁর মরদেহ পাওয়া যায়। 


বিধ্বস্ত হওয়ার ৩০ সেকেন্ড আগেও স্বাভাবিক ছিল প্রিগোঝিনকে বহনকারী বিমানবিধ্বস্ত হওয়ার ৩০ সেকেন্ড আগেও স্বাভাবিক ছিল প্রিগোঝিনকে বহনকারী বিমান

অনেকেই পেরিপিলিচনির মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ড বলে ধারণা করেছিলেন। কিন্তু ব্রিটিশ পুলিশ এমন বিষয় প্রমাণের অভাবে উড়িয়ে দেয়। তবে তাঁর পেটে জেলসেমিয়াম উদ্ভিদ থেকে তৈরি একটি বিরল এবং মারাত্মক বিষের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়। মৃত্যুর আগের দিন পেরিপিলিচনি বড় এক বাটি ভর্তি ঐতিহ্যবাহী রাশিয়ান খাবার এবং স্যুপ খেয়েছিলেন। 


এই মৃত্যুর পর সন্দেহের তীর রাশিয়ার দিকে উঠলেও মস্কো এই অভিযোগও অস্বীকার করেছে। 


ভিক্টর ইউশচেঙ্কো

ভিক্টর ইউশচেঙ্কো ইউক্রেনীয় রাজনীতিবিদ এবং দেশটির তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা। ২০০৪ সালে দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণার সময় তাঁর শরীরে বিষয় প্রয়োগ করা হয়। তিনি সেই নির্বাচনে মস্কোপন্থী প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ইয়ানুকোভিচের বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের মদতে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেছিলেন।  


‘গুলি করে’ ভূপাতিত করা হয়েছে প্রিগোঝিনের উড়োজাহাজকে‘গুলি করে’ ভূপাতিত করা হয়েছে প্রিগোঝিনের উড়োজাহাজকে

ইউশ্চেঙ্কো জানিয়েছিলেন, ইউক্রেনের নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক নৈশভোজের সময় তাঁর খাবারে বিষ মেশানো হয়েছিল। এরপর পরীক্ষায় তাঁর শরীরে স্বাভাবিকের চেয়ে ১ হাজার গুণ বেশি ডাইঅক্সিনের উপস্থিতি পাওয়া যায়। এই বিষক্রিয়ার ফলে তাঁর মুখমণ্ডল ও শরীর বিকৃত হয়ে গিয়েছিল এবং পরে বেশ কয়েক দফা অস্ত্রোপচার করে স্বাভাবিক হন তিনি। 


ইউক্রেনে সংঘটিত কমলা বিপ্লবের সময় অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রথমে ভিক্টর ইয়ানুকোভিচকে জয়ী ঘোষণা করা হয়। কিন্তু পরে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট সেই ফলাফল বাতিল বলে ঘোষণা করে। পরে দ্বিতীয় দফায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ইউশচেঙ্কো বিপুল ভোটে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। 


অ্যানা পলিতকোভস্কায়া

মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিক অ্যানা পলিতকোভস্কায়াকে ২০০৬ সালের ৭ অক্টোবর তাঁর ফ্ল্যাটের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়। গুলি করার ঠিক আগে অ্যানা স্থানীয় সুপারমার্কেট থেকে বাসায় ফিরেছিলেন। অ্যানার মৃত্যুতে পশ্চিমা বিশ্ব জোর গলায় আওয়াজ তোলে রাশিয়ার মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিয়ে।


শেয়ার করুন