২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ০৯:৪৯:৫২ অপরাহ্ন
যা ইচ্ছে তোরা কর আমি সব দেখব: ছাত্রলীগ নেত্রী অন্তরা
  • আপডেট করা হয়েছে : ০১-০৩-২০২৩
যা ইচ্ছে তোরা কর আমি সব দেখব: ছাত্রলীগ নেত্রী অন্তরা

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের আস্থাভাজন সানজিদা চৌধুরী অন্তরা আবাসিক হলে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিলেন। তার মতের সঙ্গে কারও মত না মিললে তার ওপর নেমে আসত অকথ্য নির্যাতন। পান থেকে চুন খসলেই তিনি নানা ভয় দেখাতেন। নিজস্ব ক্যাডার বাহিনীর মাধ্যমে তিনি হল শাসন করতেন। তার অপকর্মে সহায়তা করত ১৩-১৪ জন সহযোগী। সহযোগীদের তিনি বলতেন, যা ইচ্ছে তোরা কর, আমি সব দেখব। হলে তার কথাই শেষ কথা ছিল।

ইবির দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে ইবি শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি অন্তরা এক আতঙ্কের নামে পরিণত হয়েছিলেন। হলে তিনি একক আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। হলে কে সিট পাবে, কে কোন ব্লকে থাকবে তা নির্ভর করত অন্তরার ওপর। তার কাছে হল প্রভোস্টও অসহায় ছিলেন। হলের কোথায় কী হচ্ছে, কাকে শায়েস্তা করতে হবে- এসব ১৩-১৪ জন সহযোগী অন্তরাকে খবর দিত। তার নির্দেশ পেলেই সহযোগীরা মুহূর্তের মধ্যে কারও ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। তার এসব কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ ছিলেন হলের আবাসিক ছাত্রীরা। তবে অন্তরার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস কেউ পেতেন না। তাকে নিয়ে সবাই ভয়ে ভয়ে থাকতেন। হল প্রভোস্টও জিম্মি ও অসহায় ছিলেন অন্তরা বাহিনীর কাছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নির্যাতনের ঘটনায় অন্তরা ও তার সহযোগী তাবাসসুম ইসলাম, ইশরাত জাহান মীম, হালিমা আক্তার ঊর্মী, মোয়াবিয়া ইসলামকে হল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। ভুক্তভোগী ছাত্রী ফুলপরীর সঙ্গে ঘটে যাওয়া পাশবিক নির্যাতনের সত্যতা দুটি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। অন্তরার সঙ্গে হল থেকে বহিষ্কৃত তিনজন এখন তাকে দুষছেন।

সূত্র জানায়, আধিপত্য ধরে রাখতে হলের নতুন ও পুরাতন দুটি ব্লকের প্রতিটি ফ্লোরে অন্তরা চারজন করে প্রতিনিধি রেখেছিলেন। এভাবে প্রতিটি ব্লকে ২০ জন করে দুই ব্লকে ৪০ জন প্রতিনিধি ছিল। এছাড়া গণরুম নিয়ন্ত্রণে ছয়টি গণরুমে তার দুজন করে ১২ জন প্রতিনিধি ছিল। ১৩৪ জনকে তারা নিয়ন্ত্রণ করত। হলে অন্তরার বিচারই শেষ বিচার এবং এসব হল প্রভোস্টকে মানতে বাধ্য করা হতো। হলের আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের এক ছাত্রী জানান, ‘অন্তরা আপু আমাদের সঙ্গে চোখ রাঙিয়ে কথা বলতেন। তাকে তো আমরা সবাই ভয় পেতাম, হলে একচেটিয়া তার একটা প্রভাব ছিল।’

সূত্র জানায়, ফুলপরীর অপরাধ ছিল অন্তরার সহযোগী ও প্রতিনিধি তাবাসসুমকে না জানিয়ে হলের কক্ষে ওঠা। এটা জেনে অন্তরা ক্ষিপ্ত হন এবং হল থেকে তাকে বের করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এজন্য প্রভোস্টকে তিনি চাপ দেন। কিন্তু অসহায় ও দরিদ্র বিবেচনায় প্রশাসন ফুলপরীকে হলে থাকার অনুমতি দিলে অন্তরা তা মেনে নিতে পারেননি। ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি ফুলপরীকে নির্যাতনের নির্দেশ দেন।

বহিষ্কৃতদের একজন জানান, অন্তরা আপু আমাদের ভয় দেখিয়ে বলেন- প্রত্যেকে এক ঘণ্টা করে ফুলপরীকে রুমে ডেকে র‌্যাগ দিবি। যা ইচ্ছা তোরা তাই করবি। যত কিছু হবে সব আমি দেখব। এগুলো করা তো ঠিক হবে না-এমন কথা বললে আপু রেগে যান এবং বলেন-দরকার হলে মেরে ফেলবি। এজন্য তিনি বড় বড় চোখ করে আমাদের ভয়ভীতি দেখান। পরে অন্তরা বলেন, ‘যা বলছি তাই কর। দরকার হলে ফুলপরীকে মেরে ফেলবি, আমি লাশ গুম করে দেব। এর পরে কিছু হলে আমি একাই দেখব, তোদের কিছু ভাবতে হবে না।’ নির্যাতনের পর অন্তরা আপু আমাদের বলেন-‘বাইরের কাউকে কিছু জানাবি না।’ পরে তিনি জোর করে আমাদের মোবাইল ফোন থেকে সব কল ও মেসেজ ডিলিট করে দেন। এ ঘটনা প্রকাশ্যে এলে এক সহযোগীকে অন্তরা বলেন, ‘আগে আমি বাঁচি, পরে তোদের বাঁচাব। চিন্তা করিস না।’

অপর অভিযুক্ত ছাত্রী যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা যা করেছি বাধ্য হয়ে করেছি। হলে থাকার জন্যই বাধ্য হয়ে কথা শুনতে হয়েছে।’ তিনি বলেন, ছাত্রলীগের কথা না শুনলে সমস্যা হতো। তাদের কথা শুনে এখন তো আরও বড় সমস্যার মধ্যে পড়েছি। আমি বুঝতেছি যে আমি শেষ হয়ে গেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘তারা বলেছিলেন আমাদের বাঁচাবেন। এখন আমাদের লাইফ হেল হয়ে গেছে। আমার সঙ্গে বাবা সাত দিন ধরে কথা বলেন না। সামনে পরীক্ষা। কিন্তু জানি না আমি পরীক্ষায় বসতে পারব কিনা। ক্যাম্পাস থেকে বহিষ্কার হয়ে বাসায় যে যাব, বাসায় আমাকে একসেপ্ট করবে কিনা-তাও জানি না।’ তবে কার নির্দেশনায় এ নির্যাতন সংঘটিত হয়েছে জানতে চাইলে তিনি তা এড়িয়ে যান।

অভিযোগ অস্বীকার করে অন্তরা যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি কাউকে হুমকি দেইনি। মেরে ফেলা বা গুম করে ফেলার এমন কথাও বলিনি। এসবের কিছুই আমি জানি না।’ জুনিয়রদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহারের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘জাতীয় কর্মসূচিতে র‌্যালিতে অংশ নেওয়ার জন্য বলতাম। এ ছাড়া কিছুই নয়।’

ইবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ফয়সাল সিদ্দিকী আরাফাত যুগান্তরকে বলেন, ঘটনার দিন আমি বাইরে ছিলাম। ওই রাতে সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে অন্তরার কথা হয়েছিল। নিজেকে রক্ষার জন্য অন্তরা আমার নাম ব্যবহার করতে পারেন।

ইবি শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাসিম আহমেদ জয় যুগান্তরকে বলেন, ঘটনার দিন থেকে এ পর্যন্ত অন্তরার সঙ্গে আমার এক মিনিটও কথা হয়নি। এ ধরনের ঘটনার প্রমাণ পেলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অন্তরার পদ পাওয়ার ক্ষেত্রে আমার রেফারেন্স ছিল না। কিভাবে পদ পেয়েছে তা আমার জানা নেই। আমার সঙ্গে তার কোনো কথা হয়নি।

মুখ ঢেকে হল ছেড়েছেন অভিযুক্তরা : অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেত্রী সানজিদা চৌধুরী অন্তরা ও তাবাসসুম ইসলাম হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী আগে থেকেই হলের বাইরে ছিলেন। একই সঙ্গে নিজ থেকে চারুকলা বিভাগের হালিমা আক্তার ঊর্মী আগে থেকে হলের বাইরে অবস্থান করছেন। তবে মঙ্গলবার দুপুরে অপর দুই অভিযুক্ত ইসরাত জাহান মিম ও মোয়াবিয়া জাহান মুখ ঢেকে হল ছেড়েছেন। আরেক অভিযুক্ত তাবাসসুম দুপুরে হল থেকে জিনিসপত্র নিয়ে গেছেন। মিম ও ঊর্মীর হল ছাড়ার বিষয়টি প্রভোস্ট নিশ্চিত করেছেন। অন্তরা যুগান্তরকে বলেন, ‘হল ছেড়ে দিয়েছি। হলে যাইনি। আমার এক বান্ধবীর মাধ্যমে হল থেকে জিনিসপত্র নিয়ে এসেছি।

শেয়ার করুন