দেশের বাজারে পেঁয়াজের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়ানো হচ্ছে। গত তিন দিনের ব্যবধানে রাজধানীর খুচরা বাজারে পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি ৪০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায় উঠেছে। বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটচক্র ইচ্ছাকৃতভাবে সরবরাহ কমিয়ে দাম বাড়াচ্ছে। যার মূল লক্ষ্য ভোক্তার পকেট কাটা।
সরকারকে ভারত থেকে আমদানির অনুমতি দিতে চাপ সৃষ্টি করাই তাদের বড় উদ্দেশ্য। অথচ মাঠে নতুন পেঁয়াজ ওঠা শুরু হয়েছে। আরো কয়েক সপ্তাহের মধ্যে বাজার নতুন পেঁয়াজে ভরে যাওয়ার কথা।
এদিকে পেঁয়াজের বাজার সহনীয় রাখতে আজ থেকে সীমিত আকারে আমদানির অনুমতি দিচ্ছে সরকার।
গতকাল শনিবার কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়। এতে বলা হয়, প্রতিদিন ৫০টি করে আইপি ইস্যু করা হবে। প্রতিটি আইপিতে সর্বোচ্চ ৩০ টন পেঁয়াজের অনুমোদন দেওয়া হবে।
মাত্র দুই-তিন দিনের ব্যবধানে পেঁয়াজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে সাধারণ ক্রেতাদের মনে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
ব্যবসায়ীরা দুষছেন উৎপাদন অঞ্চলের কম সরবরাহকে। আর বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিযোগ একটি সিন্ডিকেট মজুদ আটকে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে। একই সঙ্গে কিছু ব্যবসায়ী ভারত থেকে আমদানির অনুমতি পেতে সরকারকে চাপ দিচ্ছিল বলেও অভিযোগ উঠেছে।
তবে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আগেই ঘোষণা দিয়েছে পেঁয়াজের দাম ১৫০ টাকা অতিক্রম করলে আমদানির অনুমতি দেওয়া হবে। এ জন্য সিন্ডিকেট করে একটি চক্র কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়াচ্ছে।
বাস্তবে কোনো ঘাটতি নেই। এরই মধ্যে বাজারে নতুন পেঁয়াজ আসা শুরু হয়েছে।
আমদানিকারকরা বলছেন, বাণিজ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের একগুঁয়েমির কারণে সাধারণ ভোক্তাদের ১৬০ টাকায় পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে। কৃষকের স্বার্থে কথা বলে তাঁরা আমদানির অনুমতি দিচ্ছেন না। অথচ আমদানির অনুমতি দেওয়া হলে ৫০ থেকে ৬০ টাকায় ভোক্তারা কিনতে পারতেন।
এ বিষয়ে পেঁয়াজ আমদানিকারক ও শ্যামবাজার পেঁয়াজ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আব্দুল মাজেদ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পেঁয়াজ নিয়ে যে বাড়াবাড়ি চলছে, সেটা আসলে আমদানির অনুমতি না দেওয়ারই একটি ফল। বাণিজ্যসচিব যদি আগামীকাল (রবিবার) পেঁয়াজ আমদানির অর্ডার না দেন, তাহলে সেটি ২০০ টাকায় ঠেকবে। বাণিজ্যসচিব ইচ্ছা করে এই কাজটি করলেন। সাধারণ মানুষ যাতে পেঁয়াজ ৫০ থেকে ৬০ টাকায় খেতে পারে সেই ব্যবস্থাটি তিনি করেননি।’
তিনি বলেন, ‘মূল্যবৃদ্ধির জন্য বারবার ‘সিন্ডিকেট’ শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রশ্ন হলো সিন্ডিকেট কারা? কার কাছে পেঁয়াজ জমা আছে? বাস্তবে গ্রামগঞ্জে নতুন পেঁয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না বলেই বাজারে চাপ তৈরি হয়েছে। আগামীকাল (রবিবার) অর্ডার পৌঁছলে পেঁয়াজের দাম এক লাফে ৭০ থেকে ৮০ টাকা কমে যাবে, পরের দিন আরো কমে শুধু মাত্র ৫০ টাকায় চলে আসবে পেঁয়াজের দাম। তাই সিন্ডিকেটের গল্প না বলে বাস্তবতা বোঝা দরকার, সরবরাহ ঠিক থাকলে দাম স্বাভাবিক হবেই।’
এদিকে গত সপ্তাহে কৃষি উপদেষ্টা জানিয়েছিলেন, পেঁয়াজের পর্যাপ্ত মজুদ আছে। নতুন পেঁয়াজও শিগগিরই বাজারে চলে আসবে। তাই কৃষকের স্বার্থ রক্ষায় আমদানির অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। সরকারের এমন পদক্ষেপের সুযোগ নিচ্ছেন মজুদদাররা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন উইং অতিরিক্ত পরিচালক (মনিটরিং ও বাস্তবায়ন) ড. মো. জামাল উদ্দীন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাস্তবে বাজারে পেঁয়াজের কোনো ঘাটতি নেই। সিন্ডিকেট চক্র ইচ্ছা করে সংকট তৈরি করছে, আমদানির অনুমতি আদায়ের জন্য দাম বাড়াচ্ছে। দেশের বিভিন্ন গুদামে এখনো এক লাখ টনের বেশি পেঁয়াজ রয়েছে।’
ড. মো. জামাল উদ্দীন আরো বলেন, ‘গত বছর প্রায় চার লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে, তার আগের বছর সাড়ে সাত লাখ মেট্রিক টন। কিন্তু এবার উৎপাদন ভালো হওয়ায় মাত্র ১২ হাজার ৯০০ মেট্রিক টন আমদানি হয়েছে। বর্তমানে দেশে পেঁয়াজের মোট উৎপাদন প্রায় ৪৪ লাখ মেট্রিক টন, আর চাহিদা ২৮ লাখ মেট্রিক টন। তবে পুরো উৎপাদন বাজারে থাকে না, সংরক্ষণ সীমিত, আর সস্তা হলে জনগণ সবজি হিসেবে বেশি পেঁয়াজ খায়। এটা স্বাভাবিক। তার পরও আমরা চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি উৎপাদন করতে পারছি। যদি আমরা সংরক্ষণ সুবিধা আরো বাড়াতে পারি তাহলে দেশের উৎপাদন আরো স্থিতিশীল হবে।’
গতকাল শনিবার রাজধানীর মহাখালী কাঁচাবাজার, রামপুরা, বাড্ডা ও জোয়ারসাহারা বাজারে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত তিন দিন আগেও তাঁরা প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ মান ভেদে ১১০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি করেন। পাইকারিতে দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে তাঁরা এখন ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি করছেন। রাজধানীর জোয়ারসাহারা বাজারের মুদি ব্যবসায়ী মো. নজরুল ইসলাম গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেশি পেঁয়াজের সরবরাহ কমে যাওয়ার কারণে পাইকারিতেই পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি ৪০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে। যার কারণে আমাদের বাড়তি দরে কিনতে হয়েছে। প্রতি কেজি পেঁয়াজ মানভেদে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে।’
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের আড়তদার জালাল উদ্দিন গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পুরনো পেঁয়াজের সংকটে দাম বেড়েছে। হঠাৎ দাম বেড়ে ভালোমানের পেঁয়াজের কেজি পাইকারিতে ১৫০ টাকায় উঠেছিল। আজ (শনিবার) আড়তে ভালোমানের পেঁয়াজ কেজিতে ১০ টাকা কমে ১৪০ টাকায় বিক্রি হয়। ছোট সাইজের পেঁয়াজ ১৩০ টাকায় পাইকারিতে বিক্রি হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘পেঁয়াজের এই দর থাকবে না, কিছুদিনের মধ্যে বাজারে নতুন পেঁয়াজ আসা শুরু হলে তখন দাম ১০০ টাকার নিচে নেমে যাবে।’
কৃষি মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কালের কণ্ঠকে বলছেন, কৃষক পর্যায়ে সংরক্ষণের সুবিধা বাড়াতে কৃষি মন্ত্রণালয় এ বছর প্রায় চার হাজার ‘এয়ারফ্লো মেশিন’ বিতরণ করেছে। প্রতিটি মেশিনে প্রায় ১২ মেট্রিক টন পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা যায়। এ কারণে কৃষক এখন নিজের পেঁয়াজ নিজেই রাখতে পারছেন ও পচন কমেছে। বাজারে ভালো দাম পেয়ে কৃষকরা এবার বেশি মুড়িকাটা পেঁয়াজ উৎপাদন করছেন, যা প্রায় সাড়ে চার লাখ মেট্রিক টনের মতো। এরই মধ্যে এই পেঁয়াজ বাজারে আসা শুরু করেছে।

