১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০২:৩০:৫৭ অপরাহ্ন
তিনতলা বাড়ির মালিকও টিসিবি কার্ডে ‘দিনমজুর’
  • আপডেট করা হয়েছে : ১১-০৯-২০২৫
তিনতলা বাড়ির মালিকও টিসিবি কার্ডে ‘দিনমজুর’

কারও তিনতলা বাড়ি আছে, কেউ আবার প্রাইভেট কারে চড়ে বেড়ান- তবুও কাগজে কলমে তারা দিনমজুর। রাজশাহী মহানগরের ৩ নম্বর ওয়ার্ডে এভাবে দিনমজুরের সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে গেছে।


অনুসন্ধানে জানা গেছে, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) কার্ড পেতে এমন চতুরতার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। এতে প্রকৃত দুস্থরা বঞ্চিত হয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে রাজশাহীর জেলা প্রশাসকের কাছেও লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে।


অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী ফজলুর রহমানকে দিনমজুর পরিচয়ে টিসিবির কার্ড দেওয়া হয়েছে। অথচ তাঁর রয়েছে তিনতলা বাড়ি। ওয়ার্ডের অভিজাত এলাকা ব্যাংক কলোনির আমির হামজা রোডের ২ নম্বর বাড়িটি তাঁর।


যোগাযোগ করা হলে ফজলুর রহমান জানান, তিনি কার্ডের আবেদন করেছিলেন। তবে কেন পেশা হিসেবে দিনমজুর লেখা হলো জানতে চাইলে তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দেন।


রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী তাজবুল হকও কার্ড পেয়েছেন। দাসপুকুর মোড়ের জব্বারের মহল্লায় তাঁর নিজস্ব বাড়ি রয়েছে। তাঁর চার ছেলেকে তিনি একই পাড়ায় চারটি আলাদা বাড়ি করে দিয়েছেন। বড় ছেলে শামিম বর্তমানে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে চাকরি করছেন। তাঁর মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।


ওয়ার্ডের বাসিন্দা রবিউল ইসলামও দিনমজুর পরিচয়ে কার্ড পেয়েছেন। অথচ শহরের নওদাপাড়া আমচত্বর এলাকায় তাঁর বড় হোটেল আছে এবং দাসপুকুর মহল্লায় রয়েছে তিনতলা বাড়ি। তিনি প্রাইভেট কার ব্যবহার করেন বলেও জানা গেছে।


এলাকাবাসী জানান, বিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্ত রবিউল কীভাবে গরিবের কার্ড পেলেন, তা তাঁদের কাছে বিস্ময়কর।


জানতে চাইলে রবিউল দাবি করেন, তাঁর আধা কাঠা জমির ওপর একটি একতলা বাড়ি রয়েছে। গাড়ি থাকার অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেন এবং জানান, পরিচিতদের গাড়ি মাঝে মাঝে ব্যবহার করেন। তবে দিনমজুর পরিচয়ে কার্ড নেওয়ার বিষয়ে তিনি কোনো উত্তর দেননি।


কাজী নাজমুল কবির, যিনি রাজশাহী বিভাগীয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কালচারাল একাডেমিতে অফিস সহায়ক হিসেবে চাকরি করেন, তিনিও কার্ড পেয়েছেন। তাঁর কার্ডেও পেশা হিসেবে দিনমজুর লেখা হয়েছে।


এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্র মহল্লার লোকজন নিয়েছিলেন। কার্ডে কোন পেশা লেখা হয়েছে, তিনি জানেন না।


এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সিটি করপোরেশন পুরোনো কার্ড বাতিল করে নতুন তালিকা তৈরি করে। এ তালিকা তৈরিতে দুটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিয়ে একটি কমিটি করা হয়। বর্তমানে এই ওয়ার্ডে ২ হাজার ৫৩০টি কার্ড রয়েছে, যার মধ্যে কিছু সম্প্রতি বিতরণ করা হয়েছে।


তবে তালিকায় প্রকৃত দুস্থদের বাদ দিয়ে সচ্ছলদের নাম যুক্ত করা হয়েছে। বাদ পড়েছেন গরিব, দিনমজুর, বিধবা, এমনকি প্রতিবন্ধীরাও।


এমনই একজন মাসদার আলী (৫০)। তিনি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাজারে ঝাড়ু দেন এবং মাস শেষে পান মাত্র সাড়ে ৪ হাজার টাকা। আগে তাঁর টিসিবির একটি কার্ড ছিল, এবার তা বাতিল করা হয়েছে।


আজাদ আলী (৬০) জানান, তিনি নানা অসুখে ভুগতে ভুগতে এখনও রংমিস্ত্রির কাজ করেন। সংসারে সচ্ছলতা থাকলে তাঁকে এ বয়সে কাজ করতে হতো না। তাঁর কার্ডটিও এবার বাতিল করা হয়েছে।


এ বিষয়ে কার্ডের তালিকা বাতিল ও নতুন তালিকা প্রণয়নের দাবি জানিয়ে ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি সালমগীর হোসেন এবং সাধারণ সম্পাদক শামীম হোসেন স্বপন রাজশাহীর জেলা প্রশাসক ও সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে গত ২৫ জুন, ৮ আগস্ট এবং সর্বশেষ ৪ সেপ্টেম্বর তিন দফা লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।


সালমগীর হোসেন বলেন, “তালিকা বাতিল করে নতুনভাবে স্বচ্ছতার সঙ্গে কার্ড প্রণয়ন না হলে গরিব, প্রতিবন্ধী এবং অসহায় মানুষের অধিকার বঞ্চিত হতে থাকবে। আমরা এলাকাবাসীকে নিয়ে অচিরেই কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করব।”

শেয়ার করুন