বাংলাদেশ টেলিভিশনের যাত্রার পর থেকেই দেখা যেত, মঞ্চের জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পীরাই অভিনয় করতেন টিভিতে। এমনকি প্যাকেজ নাটক, স্যাটেলাইট চ্যানেল চালু হওয়ার পরও টিভিতে মঞ্চাভিনেতাদের দাপট দেখা গেছে। গত কয়েক বছরে তাদের সংখ্যা কমে এসেছে। কেন এমন হলো? জানিয়েছেন উভয় মাধ্যমের জনপ্রিয় তিন শিল্পী— তারিক আনাম খান, আজিজুল হাকিম ও ইন্তেখাব দিনার।
আজিজুল হাকিম, নির্দেশক-অভিনেতা
বাংলাদেশে মঞ্চনাটকের উত্থান যখন থেকে, তখন থেকেই বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে শিল্পের এই মাধ্যম। আমরা যারা অভিনয় করতে আসতাম তাদের চিন্তাই ছিল, আগে মঞ্চের জন্য নিজেকে প্রমাণ করতে হবে। পাশাপাশি বিটিভির প্রযোজনায় কিছু নাটক, আদতে দেখা গেল ওখানেও সবাই মঞ্চেরই মানুষ। তখনো অভিনয়কে সেভাবে কেউ পেশা হিসেবে নেয়নি, পেশা হিসেবে নেওয়া শুরু করে প্যাকেজ নাটক চালু হওয়ার পর।
দেখা গেল, সেখানে অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা আছে, দর্শকপ্রিয়তাও আছে। স্বাভাবিকভাবেই যারা মঞ্চে সময় দিত, তারা প্যাকেজে সময় দেওয়া শুরু করল। তখন আর নিয়মিতভাবে রিহার্সাল করে মঞ্চে অভিনয় করা সম্ভব হয়ে উঠত না। আমিও মঞ্চে অভিনয় কমিয়ে দিয়েছিলাম।
আমার দল ‘আরণ্যক’-এর ‘জয়জয়ন্তী’র পর কোনো নতুন নাটকে অভিনয় করিনি, পুরনো নাটকের বিশেষ প্রদর্শনীতে অভিনয় করতাম। আমার মতো আমার দলে আরো যারা ছিলেন, প্রায় সবাই প্যাকেজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এভাবেই মঞ্চের সঙ্গে টেলিভিশন নাটকের শিল্পীদের দূরত্ব বাড়ে। একসময় পরিচালকরা নিয়মিত মঞ্চনাটক দেখত, সেখানে যাদের অভিনয় ভালো লাগত তাদের টিভিনাটকে অভিনয়ের সুযোগ দিত। এখনকার পরিচালকদের মঞ্চের দিকে চেয়ে থাকতে হয় না, এখন সোশ্যাল মিডিয়া আছে।
এটাও পরিচালকের স্বাধীনতা। অন্যদিকে যারা মঞ্চের সক্রিয় কর্মী, তারা হয়তো মঞ্চের বাইরে টেলিভিশন নাটকের যে কার্যক্রম তাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না।
তারিক আনাম খান, নির্দেশক-অভিনেতা
মঞ্চের শিল্পীদের সঙ্গে টেলিভিশন নাটকের দূরত্ব বেড়েছে, এটার কারণ অনেক। প্রথমত, আমাদের এখন অনেক চ্যানেল, তারা নিজেদের দিকটাই আগে দেখে—অভিনয়ে কাকে নিলে বেশি টিআরপি পাবে। তা ছাড়া এখন টেলিভিশনের চেয়ে ইউটিউবেই দর্শক নাটক দেখে বেশি—সেখানে তো ভিউ, স্পন্সরের খেলা। অন্যদিকে কাজ করতে করতে যাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক হয়েছে, নির্মাতারা তাদের নিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তবে আমি বলব, এখনো অভিনয়ের সেরা মাধ্যম মঞ্চ বা থিয়েটার। ওখানে অভিনয়ের একদম প্রাথমিক থেকে পরিপূর্ণ শিক্ষা আয়ত্ত করা যায়। ‘পারফেকশনিস্ট’ বলতে যেটা বুঝি, সেটা থিয়েটার থেকেই শেখা যায়।
তবে মঞ্চে পেশাদারির খুব অভাব, যার কারণে খুব ভালো কাজ হলেও ঠিকঠাকভাবে দাঁড়াতে পারেনি মঞ্চ। আমরা অনেকেই বিকল্প খুঁজে নিয়েছি। মঞ্চের শিল্পীদের অভিনয়ের ক্ষুধা তীব্র, ডাকলে অবশ্যই তাঁরা টিভিনাটক, ওয়েব, চলচ্চিত্রে অভিনয় করবেন। কিছু ব্যতিক্রমী শিল্পী হয়তো আছেন, যাঁরা মঞ্চে অভিনয়েই বেশি আগ্রহী। তাঁদের সঙ্গে দূরত্ব ক্রমেই বাড়ছে। তা ছাড়া এখনকার টিভিনাটকে বৈচিত্র্য নেই, যেটা মঞ্চের শিল্পীদের পছন্দ হবে না। আমাকেও পছন্দের বাইরে গিয়ে অভিনয় করতে হয়। বেশ কয়েক বছর ধরেই নাটকের প্রধান মুখরা আসছেন মডেলিং থেকে, অভিনয়ে যাদের হাতেখড়ি হয় টিভিনাটক করতে এসে। দ্রুতই তাদের চাহিদা বাড়ে, অভিনয়েও ব্যস্ততা বাড়ে। তাদের আর মঞ্চের প্রতি তেমন আগ্রহ থাকে না।
ইন্তেখাব দিনার, অভিনেতা
আমার জায়গা থেকে আসলে সঠিক বিশ্লেষণ করতে পারব না। কারণ আমি দীর্ঘদিন মঞ্চ থেকে দূরে। তবে আমি যখন কাজ করেছি, সেই সময়ের অভিজ্ঞতা থেকে যদি বলি, আমার অভিনয় শেখার তাগিদ ছিল। আমাদের কোনো ইনস্টিটিউট যেহেতু নেই মঞ্চকেই অভিনয়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে বেছে নিয়েছি। তার মানে এই নয়, মঞ্চকেই অভিনয় শেখার মাধ্যম হিসেবে নিতে হবে। যে যে মাধ্যম থেকে শিখে আসুক, ভালোভাবে শিখলেই হবে। মঞ্চে অভিনয়ে অনাগ্রহের কারণ দিন দিন প্রকট হচ্ছে। অনেক কারণ। সবচেয়ে বড় কারণ, মঞ্চ এখনো পেশাদার হয়ে উঠতে পারেনি। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো অবস্থা। একসময় আমিও করেছি, কিন্তু পরবর্তী সময়ে বাস্তবিক কারণে সরে এসেছি।
আমার মতো অনেকেই আছেন। মঞ্চে রিহার্সাল খুব গুরুত্বপূর্ণ, যেহেতু বেশির ভাগ শিল্পীই উত্তরার দিকে থাকেন, এই দীর্ঘ জ্যাম ঠেলে শিল্পকলায় রিহার্সাল করাটা অনেক সময়ের ব্যাপার। তা ছাড়া মঞ্চ থেকে যেহেতু আয় নেই, অভিনেতাকে বিকল্প পথ বেছে নিতে হয়। কেউ কেউ চাকরিও করছেন, অফিস শেষে সারা দিনের ক্লান্তি নিয়ে রিহার্সাল করাটা কঠিন ব্যাপার। মঞ্চ পেশাদার হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। অন্যদিকে টিভিনাটকে যাঁরা অভিনয় করছেন তাঁদের আগমনের পথটা ভিন্ন। তাঁরা বিভিন্ন রিয়ালিটি শো, বিজ্ঞাপন বা সোশ্যাল কনটেন্ট ক্রিয়েটর হয়ে আসছেন, তাঁরা এখানেই গ্রুমড হচ্ছেন। মঞ্চে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। মঞ্চে যাঁরা এখন সক্রিয়, তাঁদের সঙ্গেও টেলিভিশন বা ইউটিউবের দূরত্ব অনেক বেড়েছে। তবে হ্যাঁ, ওটিটিতে তাঁদের পাওয়া যায়। দুই মাধ্যমেই ভালো ভালো অভিনয়শিল্পী আছেন, এখন পর্যন্ত নতুন প্রজন্মের যাঁদের সঙ্গে কাজ করেছি আমার অভিজ্ঞতা ভালো।