ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে শরিয়তপুর রুটে চলাচল করা শরিয়তপুর সুপার সার্ভিস নামের একটি পরিবহন কোম্পানির কাছে পাঁচ কোটি টাকা অথবা মাসে দশ লাখ টাকা চাঁদা দাবির একটি অভিযোগ ওঠে চলতি মাসে।
টাকা না পেয়ে ওই পরিবহনের বেশকয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। আটই জুলাই থেকে তিন-চারদিন যাত্রাবাড়ী থেকে শরিয়তপুর সুপার সার্ভিসের বাস চলাচলও বন্ধ করে দেওয়া হয়। বাসের কর্মচারীদেরও মারধর করার অভিযোগ ওঠে।
এ ঘটনার প্রতিবাদে পদ্মাসেতুর জাজিরা প্রান্তে টোল প্লাজার কাছে সড়ক বন্ধ করে বিক্ষোভ মিছিল ও মানবন্ধন হয়।
শরিয়তপুর সুপার সার্ভিস পরিবহনে চাঁদা দাবির এই অভিযোগ ওঠে যাত্রাবাড়ী থানা যুবদলের একজন পদধারি নেতার বিরুদ্ধে। ১২ই জুলাই তাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করে বিজ্ঞপ্তি দেয় সংগঠনটি।
দলীয় পরিচয় ব্যবহার করে বেআইনি কর্মকাণ্ডে জড়িত হলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণেরও আহ্বান জানানোর কথা উল্লেখ করা হয় সংগঠনের পক্ষে।
শরিয়তপুর সুপার সার্ভিসের একটি বাসের ম্যানেজার জানান, অতীতে এই রুটে গাড়ি প্রতিদিন পঞ্চাশ থেকে একশ টাকা চাঁদা দিয়ে চলাচল করতো। ৫ই অগাস্টের পর দৈনিক গাড়ি প্রতি পাঁচশো টাকা চাঁদা দেওয়া শুরু হয়। বিএনপির যুবদল নেতাকে বহিষ্কারের ঘটনার পর থেকে দৈনিক পাচশো টাকা চাঁদা দেওয়াও তারা বন্ধ রেখেছেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সারাদেশে পাঁচই অগাস্টের পর দখল চাঁদাবাজি এবং আধিপত্য বিস্তারকে ঘিরে সমালোচিত হচ্ছে বিএনপি। সম্প্রতি মিডফোর্ড এলাকায় সোহাগ হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর বিএনপির বিরুদ্ধে সমালোচনা জোরালো হয়েছে।
গত ১১ মাসে চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব ও হামলার নানা অভিযোগে চার হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে বহিষ্কারও করেছে বিএনপি। বিশ্লেষকরা মনে করেন ক্ষমতায় যাওয়ার আগেই বিএনপি যেসব বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছে, তাতে দলটির ওপর একটা বড় চাপ তৈরি হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. সাব্বির আহমেদ বলেন, বিএনপির রাজনৈতিক চরিত্র আওয়ামী লীগের মতোই।
"পাল্টাপাল্টি কাজ করার রাজনীতি, এটা হলো বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে বড় সমস্যা। এখন বিএনপি মনে করতেছে, তারা সতের বছর খাইছে, আমরা খাবো না! এবং ক্ষেত্রবিশেষে আমরা দেখি, দলের কেন্দ্রীয় নেতারা এরকম ইন্ধন দেয় যে, আওয়ামী লীগ সতের বছর খাইছে- আমরা খাব।
"তোরা সাবধানে চাঁদাবাজি করবি... দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের মুখ থেকে যদি এইসব কথা শুনি তাহলে সে দলের অবস্থাতো ভয়াবহ" বলেন সাব্বির আহমেদ।
এদিকে, ক্ষমতায় আসার আগেই বিএনপির রাজনৈতিক পরিচয়ে নানারকম কর্মকাণ্ডে দলের একটি অংশ বিব্রত। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় অনেকে বিষয়টি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন।
তৃণমূল নেতা কর্মীদের অভিযোগ দলের মধ্যে অনুপ্রবেশকারী ঢুকেছে, ক্ষেত্রবিশেষে আশ্রয়, প্রশ্রয় পাচ্ছে।
কিন্তু অভ্যুত্থানের পর এমন সংকটে কেন পড়লো বিএনপি, তৃণমূল নেতাকর্মীরা কতটা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণে আছে-এ সব প্রশ্নের মুখে পড়ছে বিএনপি।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ বলেন, দলের কালচারটা চেঞ্জ হয়ে গেছে। দলের আনুগত্য করা, নেতাকে মানা এই জিনিসগুলো এখন দুর্বল হয়ে গেছে। তার কারণ হলো আদর্শিক চর্চা নাই দলের মধ্যে।
"গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে সঙ্গে সারাদেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিষ্ঠানগুলো দখল করে নেয়া;এর সঙ্গে বিএনপিকে বাড়তি প্রণোদনা জুগিয়েছে এই চাঁদাবাজি।
"সামগ্রিকভাবে ভুলটা হলো ড. ইউনূসের। নতুন বন্দোবস্তকে নতুন রাখাটাই উত্তম ছিল। কিন্তু তিনি বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি- সবাইকে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন লাভজনক জায়গায় তাদেরকে অধিষ্ঠিত করার মাধ্যমে এমন একটা বন্দোবস্ত তৈরি করছেন যে, এটি কাজে লাগিয়ে দলগুলো ইচ্ছেমতো তাদের সুযোগগুলোকে ব্যবহার করছে।"
পাঁচই অগাস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পর থেকে সারাদেশে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ক্ষমতা ও প্রভাব দৃশ্যমান হয়েছে। দলটির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযোগও অনেক বেশি সামনে এসেছে।
পাঁচই অগাস্ট পরবর্তী দখল ও হামলার মতো অভিযোগ নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বিবিসি বাংলাকে বলেন, "আমি আমার সম্পদটা এতদিন পাই নাই, এখন প্রশাসনের মাধ্যমে বা তারা না থাকায় আমি পাইলাম, এটা কি দখলবাজিতে পড়ে? পড়ে না।
"তাই দখলবাজির খবরটা ভেইগ। আমরাতো এই দেশেরই মানুষ। এই দেশের মানুষই, জামায়াত করে, হেফাজত করে, আওয়ামী লীগ করে, জাসদ করে, বাসদ করে বিএনপিও করে। আমার সমাজ ব্যবস্থার যেখানে অবক্ষয়, যারা সতের বছর কোর্টে হাজিরা দিতে দিতে নিঃস্ব হয়ে গেছে, বছরের পর বছর জেল খাটছে, বাড়িঘরে থাকতে পারে নাই। তাদের মধ্যে সবাই যে একরকম তা না।
"প্রতিশোধ পরায়ণতা কিন্তু মানুষের একটা সহজাত ধর্ম। এইটার উর্ধ্বে যারা তারাতো মহামানব, আমরাতো কেউ মহামানবের কাতারে পড়ি না। সেক্ষেত্রে আমরা দলীয়ভাবে অনেককেই বহিষ্কার করছি" বলেন গয়েশ্বর চন্দ্র রায়।
বিএনপির এই নেতা বলেন, "একটা সুবিধাবাদী গোষ্ঠী থাকে, তারা সব সরকারের সময়ে সুবিধা নেয়। আমরা এখনো সরকারে আসি নাই, কিন্তু অনেকেই এতদিন যারা আতাঁত করে চলেছে হঠাৎ করে তারা বিপ্লবী হয়ে গেছে, তারা সব এখন বিএনপি হয়ে গেছে। এই গোষ্ঠীটা আমাদের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর। আমরা সেগুলোকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি।
"এখন আমাদের ছেলেদের মধ্যে প্রশ্ন ওঠে ওতো এতদিন আওয়ামী লীগের সাথে চলছে। এটা নিয়ে আমাদের নিজেদের মধ্যেই একটা গৃহদ্বন্দ্ব আছে।
"আরেকটি জিনিস হলো, আমরা যতগুলো লোককে বহিষ্কার করলাম হয়তো আমরা বিশ্বাস করছি তার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো সত্য, কিন্তু আমি যখন একজনকে অপরাধের কারণে বহিষ্কার করি- তখন প্রশাসনের সুযোগ তাকে আইনের আওতায় নেওয়ার। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমরা যতলোককে বহিষ্কার করছি, প্রশাসন কি তাদেরকে আইনের আওতায় নিছে। কেন নেয় না" প্রশ্ন গয়েশ্বর রায়ের।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচন হলে আগামীতে বিএনপির ক্ষমতায় যাবার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি। সেক্ষেত্রে দখল-চাঁদাবাজির মতো অপরাধের নানা অভিযোগ দলটিকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।
যদিও বিএনপির হাইকমান্ড থেকে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা হয়েছে বলেও দাবি করা হচ্ছে।
দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপদেষ্টা মাহদী আমিন বিবিসি বাংলাকে বলেন, দলের শৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজ যে কেউ যদি করে থাকে, দল থেকে জিরো টলারেন্স পলিসি নেওয়া হচ্ছে এবং সর্বোচ্চ সাংগঠনিক ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে।
"আমি যদি মিডফোর্ডের ঘটনাই দেখি অভিযোগ আসা মাত্রই কোনো তদন্তের আগেই যাদের নাম এসেছে, সবাইকে কিন্তু সেখান থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, যারা ইট- পাথর দিয়ে হত্যা করেছে, তাদের নাম কিন্তু এজাহারে আসে নাই তারা কেউ বিএনপির সাথে সম্পৃক্তও নয়।"
মাহদী আমিন বলেন, "বিএনপির বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ উঠছে, যেগুলো তদন্তের পর সত্যতা পাওয়া যাচ্ছে, আবার অনেক অভিযোগ রয়েছে যেগুলো অপপ্রচার, ষড়যন্ত্র এবং যেগুলো অতিরঞ্জিত।
"অনেক সময় দেখা যায় যে, বিএনপির কোনো নেতা বা কর্মীর যে লুণ্ঠিত সম্পত্তি সেটা পুনরুদ্ধার করতে গেলে, সেটাকেও বলা হচ্ছে দখলদারিত্ব। অনেক সময় দেখা যাচ্ছে নব্য বিএনপির নামধারী কিছু পতিত স্বৈরাচারের দোসর তারা গিয়ে বিএনপির নাম ভাঙাচ্ছে" উল্লেখ করেন মাহদী আমিন।
চাঁদাবাজি, আইন শৃঙ্খলার বিভিন্ন সংকট সামনে এনে জামায়াত এবং এনসিপিকে বিএনপির সমালোচনা করতে দেখা যাচ্ছে।
পুরোনো ঢাকায় মিডফোর্ড এলাকার আলোচিত হত্যাকাণ্ড এবং সাম্প্রতিক কিছু চাঁদাবাজির ঘটনায় বিএনপিকে ঘিরে সমালোচনামূলক প্রচারণা দেখা যাচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল হয়েছে, বিএনপির ছাত্র সংগঠন ও তাদের শীর্ষ নেতাকে কটূক্তি করে স্লোগান দিতেও দেখা গেছে। তবে এগুলোকে নির্বাচন পেছানোর একটা 'ষড়যন্ত্র' হিসেবে উল্লেখ করছে বিএনপি।
মাহদী আমিন বলছেন, মিটফোর্ড এলাকায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনার দুই দিন পর হঠাৎ করে অনলাইনে আনা হলো। এরপর আগে থেকে রেডি করে রাখা বেশ কিছু ফটোকার্ড ভিডিও ভাইরাল করা হলো নির্দিষ্ট কিছু আইডি থেকে।
"এটাতো ক্লিয়ার এটা নিয়ে একটা মিসলিডিং ক্যাম্পেইন করা হয়েছে, ডিজইনফরমেশন করা হয়েছে একটা পার্টিকুলার পলিটিক্যাল পার্টিকে মেলাইন করার জন্য।
"বিএনপি যেভাবে অভিযোগ আসার সাথে সাথে কোনো তদন্ত ছাড়াই সবাইকে বহিষ্কার করে দিল। সেটাকে সাধুবাদ না জানিয়ে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকে যেভাবে আক্রমণাত্মক ভাষায় কথা বলা হয়েছে, অশালীন ব্যবহার করা হয়েছে। যেভাবে আমরা রাজনৈতিক শিষ্ঠাচার বহির্ভুত আচরণ দেখেছি এটাতো গণ অভ্যুত্থানের আকাঙ্খা ছিল না" বলেন মাহদী আমিন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাব্বির আহমেদ বলেন, এর পেছনে সন্দেহ কাজ করা স্বাভাবিক।
"কিছু প্রশ্নতো উদয় হয় স্বাভাবিক। ধরেন যে ছেলেটা পাথর দিয়ে মারছে ওকে কেন এনসিপির নেতাদের সাথে দেখা যাচ্ছে। এটাতো একটা প্রশ্ন।
"বিএনপিতো পুলিশকে বলছে নির্বিঘ্নে ধরেন তদন্ত করেন তাদের বিরুদ্ধে। এটা বলেই দিছে তারা। তারপর এই যে অশ্লীল স্লোগান তারেক জিয়ার বিরুদ্ধে। এইগুলো কারা করাচ্ছে। এগুলোর অর্থ কী। একটা ঘটনা ঘটে গেছে এখন তদন্ত হবে, বিচার হবে, সেই কথাটা না বলে তারা তারেক জিয়ার বিরুদ্ধে মিছিল বের করে দিছে। তো এই ধরনের কিছু গন্ধতো পাওয়া যায় যে এটার পরিকল্পনা থাকতে পারে এর পিছনে, অস্বাভাবিক কিছু না" মনে করেন বিশ্লেষক সাব্বির আহমেদ।