৩০ জুন ২০২৫, সোমবার, ০৭:৩৮:৪৬ অপরাহ্ন
ইরান-যুক্তরাষ্ট্র, পরমাণু প্রযুক্তি থেকে পরমাণু যুদ্ধের পথে
  • আপডেট করা হয়েছে : ৩০-০৬-২০২৫
ইরান-যুক্তরাষ্ট্র, পরমাণু প্রযুক্তি থেকে পরমাণু যুদ্ধের পথে

গত দুই দশক ধরে বিশ্ব রাজনীতিতে অন্যতম আলোচিত ইস্যু হয়ে রয়েছে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি। ২০০৩ সালে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা জানায়, তেহরান গোপনে প্রায় ১৮ বছর ধরে একটি গোপন পারমাণবিক কর্মসূচি চালিয়ে আসছে, তখন থেকেই এই ইস্যুটি আন্তর্জাতিক কূটনীতির কেন্দ্রে চলে আসে। এই তথ্য সামনে আসার পর, পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির একজন স্বাক্ষরকারী হিসেবে ইরানের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পশ্চিমা দেশগুলোর পাশাপাশি চীন ও রাশিয়ার মতো মিত্ররাও নিন্দা ও চাপের মাধ্যমে তেহরানের ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।


তৎকালীন ইরানি প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতামি দাবি করেন, পারমাণবিক কর্মসূচির উদ্দেশ্য ছিল সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ। তবে যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই সন্দেহ প্রকাশ করে আসছিল যে, ইরান গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে। এই ইস্যুটি জর্জ ডব্লিউ. বুশ থেকে জো বাইডেন পর্যন্ত সব মার্কিন প্রেসিডেন্টদের শাসনামলেই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে ছিল। ২০০২ সালে প্রেসিডেন্ট বুশ তাঁর ‘এক্সিস অব এভিল’ ভাষণে ইরানকে অন্তর্ভুক্ত করেন এবং দেশটির ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন।


পরবর্তী প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কূটনৈতিক পথে সমাধানের চেষ্টা করেন এবং যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন, রাশিয়া ও জার্মানির সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ২০১৫ সালে যৌথ সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তির আওতায় ইরান তাদের পারমাণবিক কার্যক্রম সীমিত রাখবে এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণের অধীনে রাখবে; এর বিনিময়ে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হয়।

তবে ২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে ওই চুক্তি থেকে একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে নেন এবং ইরানের বিরুদ্ধে আবার কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। এর জবাবে তেহরান চুক্তির শর্ত ভাঙতে শুরু করে এবং ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়।


যা অস্ত্র তৈরির ৯০ শতাংশ লক্ষ্যের অনেক কাছাকাছি। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করলেও তা ব্যর্থ হয়। এবং সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল যৌথভাবে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর বোমা হামলা চালিয়েছে। যার উদ্দেশ্য ছিল সেগুলো অকার্যকর করে দেওয়া। এই হামলার পরিণতি এখনো স্পষ্ট নয়, কারণ ক্ষয়ক্ষতির নিরপেক্ষ মূল্যায়ন পাওয়া যায়নি।

তবে এই সংকটের গোড়াপত্তন হয় অনেক আগে। ১৯৫০-এর দশকে, যুক্তরাষ্ট্রের হাত ধরেই ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির সূচনা ঘটে। ‘অ্যাটমস ফর পিস’ নামে পরিচিত একটি উদ্যোগের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র তেল-নির্ভর ইরানে পারমাণবিক প্রযুক্তি সরবরাহ শুরু করে। ১৯৫৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে পারমাণবিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর হয় এবং ১৯৬৭ সালে তেহরান একটি পাঁচ মেগাওয়াট চুল্লি ও উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম পায়। যদিও ১৯৭০ সালে ইরান এনপিটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে অস্ত্র না তৈরির প্রতিশ্রুতি দেয়। তবুও শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি পারমাণবিক শক্তিকে কৌশলগত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতেন। ১৯৭৪ সালে ইরান ঘোষণা দেয়, তারা ২৩টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়বে এবং পুরো জ্বালানি উৎপাদন চক্র গড়ে তুলবে। যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় এমআইটি-তে ইরানি শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। তবে ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর পারমাণবিক প্রকল্পগুলো স্থগিত হয়ে যায়।


বিপ্লব পরবর্তী রূপান্তর

বিপ্লব-পরবর্তী ইসলামি সরকার প্রথমদিকে পারমাণবিক প্রকল্পগুলো বাতিল করে দেয়। তবে পরে তারা প্রযুক্তির কৌশলগত গুরুত্ব বুঝতে পারে এবং গোপনে কর্মসূচি আবার শুরু করে। দেশত্যাগী বিজ্ঞানীদের ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি দেশীয় সক্ষমতা তৈরিতে মনোযোগ দেওয়া হয়।


শান্তির উদ্যোগ নাকি অস্ত্রের আশঙ্কা?

‘অ্যাটমস ফর পিস’ প্রকল্পটি অনেক দেশের কাছে পারমাণবিক প্রযুক্তির দরজা খুলে দেয়। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, এই উদ্যোগ কি পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তারের জন্য দায়ী? এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেন, এই উদ্যোগ শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক গবেষণার সুযোগ তৈরি করেছে। অন্যদিকে কেউ মনে করেন, এই প্রযুক্তিগত সহায়তা অস্ত্র উন্নয়নের পথ উন্মুক্ত করেছে। ভারত ও পাকিস্তানের মতো দেশের পারমাণবিক কর্মসূচির সূচনাও এই প্রকল্পের মাধ্যমে হওয়ায় বিতর্ক তীব্র হয়েছে।


এখন কোন পথে ইরান?

যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলার পর প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা আদৌ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিনা এবং ভবিষ্যৎ পথে দেশটি কী সিদ্ধান্ত নেবে। এক সময় শান্তির নামে শুরু হওয়া একটি কর্মসূচি আজ অস্ত্রের আশঙ্কা ও যুদ্ধের সম্ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে। এটাই ইতিহাসের নির্মম পরিণতি। এখন সময় এসেছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য এই জটিলতার সমাধানে সাহসী ও কৌশলগত পদক্ষেপ নেওয়ার।


সূত্র : বিবিসি বাংলা


শেয়ার করুন