১১ মে ২০২৪, শনিবার, ০২:২১:৩৩ অপরাহ্ন
জেলা কোটা নিয়ে জালিয়াতি! নিজ জেলা চাঁদপুর হলেও ঘোষণা দেন ঝিনাইদহ
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৮-০৪-২০২৪
জেলা কোটা নিয়ে জালিয়াতি! নিজ জেলা চাঁদপুর হলেও ঘোষণা দেন ঝিনাইদহ

প্রশাসন ক্যাডারে চাকরিতে যোগদান জেলা কোটায়। জেলার নাম ঝিনাইদহ। অথচ তার জেলা চাঁদপুর। চাকরির ২৮ বছর পর একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার এমন জালিয়াতির তথ্য বেরিয়ে এসেছে যুগান্তরের অনুসন্ধানে। এ কর্মকর্তা বর্তমানে অতিরিক্ত সচিব হিসাবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে কর্মরত। নাম সৈয়দা সালমা জাফরীন।


১৫তম বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের এ কর্মকর্তার জন্মস্থান ও নিজ জেলা চাঁদপুর হলেও তিনি ঝিনাইদহ জেলা দেখিয়ে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। তিনি এখনো নিজেকে ঝিনাইদহের বাসিন্দা বলে দাবি করলেও এর পক্ষে কোনো তথ্যপ্রমাণ দিতে পারেননি। এছাড়া ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের যে ঠিকানা দিয়েছেন, তার কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। ফলে প্রশাসন ক্যাডারের এ ব্যাচে ঝিনাইদহ জেলার একজন চাকরিপ্রার্থী তার প্রাপ্য কোটা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।


এদিকে সরকারের একজন অতিরিক্ত সচিব এ ধরনের জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে চাকরিতে যোগদান করায় প্রশাসনসংশ্লিষ্ট উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের অনেকে যুগান্তরের কাছে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মেজবাহ উদ্দীন চৌধুরীসহ প্রশাসন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অভিযোগটি সত্য হলে তার চাকরিতে যোগদান প্রশ্নবিদ্ধ হবে। সেক্ষত্রে মন্ত্রণালয় তথা সরকারকে আইনানুগ ব্যবস্থা না নেওয়া ছাড়া কোনো গত্যন্তর থাকবে না।


অতিরিক্ত সচিব সৈয়দা সালমা জাফরীন ১৯৯৫ সালে প্রশাসন ক্যাডার থেকে ১৫তম বিসিএস-এ পিএসসির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। সম্মিলিত মেধাতালিকায় এ ব্যাচে উত্তীর্ণ হন ৩৫২ জন। তালিকায় তার অবস্থান ৩৪৮ ক্রমিকে। চাকরিতে যোগদান করেন ওই বছর ১৫ নভেম্বর। প্রশাসন ক্যাডারের এ ব্যাচ থেকে চাকরিতে যোগ দেন ১২৫ জন। ওই তালিকায় তার সিরিয়াল ছিল ১২৪। শিক্ষাজীবনে ছাত্রলীগের সক্রিয় নেত্রী এবং হল শাখার সভানেত্রী ছিলেন। দীর্ঘ চাকরিজীবনে তিনি কোনোদিন পদোন্নতিবঞ্চিত হননি।


যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা যায়, তিনি চাঁদপুর জেলার দক্ষিণ মতলব পৌরসভার স্থায়ী বাসিন্দা। পৈতৃক বাড়ি পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডে। বিষয়টি নিশ্চিত করে মতলব দক্ষিণ পৌরসভার জনপ্রতিনিধি ওয়ার্ড কাউন্সিলর মিন্টু সাহা যুগান্তরকে জানান, সৈয়দা সালমা জাফরীন তার ওয়ার্ডের স্থায়ী বাসিন্দা। তবে তারা বছরের বেশির ভাগ সময় ঢাকায় থাকেন। বিভিন্ন সময় গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে আসেন। তিনি আরও জানান, তার নানাবাড়িও পৌরসভার পাশেই।


মতলব বোয়ালিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক খোকন চন্দ্র শীল শনিবার যুগান্তরকে বলেন, সৈয়দা সালমা জাফরীন বোয়ালিয়া স্কুলের একজন মেধাবী ছাত্রী। তিনি অনেক সিনিয়র ও সাবেক ছাত্রী। এ স্কুল থেকেই এসএসসি পাশ করেন। মতলব পৌরসভায় তাদের বিশাল বাড়ি রয়েছে। তারা তিন ভাই-বোন সবাই মেধাবী। সবাই এ স্কুলের শিক্ষার্থী। সৈয়দা সালমা জাফরীনের এক ভাই অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা। আরেক ভাই শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা এবং বর্তমানে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে কর্মরত। সৈয়দা সালমা জাফরীন বোয়ালিয়া স্কুলের জন্য ডিজিটাল কম্পিউটার ল্যাব অনুমোদন করিয়ে দিয়েছেন। স্কুলের জন্য তার অনেক অবদান রয়েছে। সৈয়দা সালমা জাফরীন ১৯৮২ সালে চাঁদপুরের দক্ষিণ মতলব বোয়ালিয়া হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাশ করেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সৈয়দা সালমা জাফরীনের ঝিনাইদহ জেলায় কোনো বাড়ি আছে কি না, তা আমাদের জানা নেই।


এ বিষয়ে জানতে চাইলে সৈয়দা সালমা জাফরীন যুগান্তরের কাছে দাবি করে বলেন, ‘আমার গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর জেলায়। এটা সঠিক। কিন্তু দেশের বিভিন্ন জেলায় আমার বাপদাদার বাড়ি, সম্পদ ও জমি রয়েছে। আমার বাবা ভাই-বোনদের নামে জেলায় জেলায় এসব সম্পদ বণ্টন করে দিয়েছেন। আমাদের ঝিনাইদহেও বাড়ি আছে। এছাড়া চাকরির সুবাদে বাবা ১৯৫১ সালে ঢাকার মোহাম্মদপুরে বাড়ি করেছেন। সেখানে এখন বহুতল ভবন তৈরি করে আমরা ভাই-বোনরা ভাগ করে নিয়েছি। এ ভবনে আমারও ফ্ল্যাট রয়েছে। আমার ছেলে-মেয়েদের সার্টিফিকেটে মোহাম্মদপুরের ঠিকানা দেওয়া হয়েছে।’


তিনি জানান, ‘আমার দাদার বাড়ি চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলায়। আমি শৈশবে সে বাড়িতে একবার গিয়েছি। বাবার সঙ্গে ঢাকায় বসবাস করায় দাদাবাড়িতে আর দ্বিতীয়বার যাওয়া হয়নি। দাদার বাড়ি কোথায়, এখন আমি চিনব না। মূলত বলতে চাচ্ছি, আমি জেলা কোটা জালিয়াতি করিনি। তাছাড়া চাকরির শুরুতে এবং প্রতিটি পদোন্নতির আগে আমার ঠিকানা যাচাই করে গোয়েন্দা প্রতিবেদন সংগ্রহ করে সরকার। কই সেখানে তো নেতিবাচক কোনো খবর বের হয়নি?’


তিনি আরও দাবি করেন, ‘কয়েকজন ব্যাচমেট আমার বিরুদ্ধে লেগেছে। আমি তাদের বিরুদ্ধে কিছুই বলব না। আল্লাহ তাদের বিচার করবে।’ সালমা জাফরীন বলেন, ‘মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব মাহবুব হোসেন স্যার আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। তিনি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে সিনিয়র সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনিই আমাকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পোস্টিংয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। যদি আমি খারাপ কর্মকর্তা হতাম, আমার কাজ যদি ভালো না হতো এবং আচরণ যদি খারাপ হতো, তাহলে তিনি কেন আমাকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে নিয়ে আসবেন। অথচ আপনারা দেখেছেন কিছুদিন ধরে আমার বিরুদ্ধে লেখালেখি হচ্ছে।’


যুগান্তরের সঙ্গে আলাপকালে সৈয়দা সালমা জাফরীন জানান, ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জের কোলা ইউনিয়নে তার গ্রামের বাড়ি। সেখানে তার দাদা-দাদির কবর রয়েছে। আর মা-বাবার কবর চাঁদপুরে। তবে বিষয়টি অনুসন্ধান করে তার বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া যায়নি।


যুগান্তরের ঝিনাইদহ জেলা প্রতিনিধি মিজানুর রহমান বেশ কয়েকদিন সরেজমিন অনুসন্ধান করে সৈয়দা সালমা জাফরীনের ঠিকানা খুঁজে পাননি। মিজানুর রহমান জানান, একজন অতিরিক্ত সচিবের বাড়ি থাকলে এলাকার মানুষ তাকে চিনবে না, জানবে না-এমনটি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।


পরবর্তী সময়ে সৈয়দা সালমা জাফরীনের কাছে ঝিনাইদহের তার গ্রামের বাড়ির ঠিকানা জানতে চাইলে তিনি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। কিছুটা রাগান্বিত হয়ে বলেন, ‘এত বছর পর কারা আমার বিরুদ্ধে লেগেছে, তাদের নাম বলেন।’


এদিকে যুগান্তরের অনুসন্ধানে সালমা জাফরীনের জম্মস্থান এবং নিজ জেলা যে চাঁদপুর, সেটি একেবারে পরিষ্কার হয়ে গেছে। কারণ, তার প্রতিটি পদোন্নতির পর চাঁদপুরের স্থানীয় পত্রিকাগুলো তাকে অভিনন্দন জানিয়ে সংবাদ পর্যন্ত প্রকাশ করেছে। এছাড়া চাঁদপুরের বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনও তাকে পদোন্নতির পর অভিনন্দন জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। ২০২২ সালের ৮ এপ্রিল ‘বাণিজ্য প্রতিদিন’ সালমা জাফরীনের ছবি দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করেছে। সেখানে বলা হয়, সৈয়দা সালমা জাফরীন অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি পাওয়ায় জেলার সর্বস্তরের জনগণ শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সালমা জাফরীন চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণের কৃতী সন্তান। তিনি ওই নিউজের কোনো প্রতিবাদও করেননি।


এছাড়া সালমা জাফরীন তার ব্যবহৃত ফেসবুক আইডিতেও নিজ জেলা চাঁদপুর হিসাবে উল্লেখ করেছেন। ব্যাচমেট এবং সহকর্মীরাও জানেন তিনি চাঁদপুরের বাসিন্দা। গত ঈদুল ফিতরে তিনি চাঁদপুরের বাড়িতে বেড়াতে গেছেন। রমাজানে মা-বাবার নামে দোয়া মাহফিল করিয়েছেন।


এ ধরনের জালজালিয়াতির বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মেজবাহ উদ্দীন চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ‘যেই হোক, এ ধরনের জালিয়াতি করলে তার চাকরিই হওয়ার কথা না। কারণ, কেউ জেলা কোটা জালিয়াতি করলে তার নিয়োগই ভুয়া। এ ধরনের নিয়োগ সম্পূর্ণ বেআইনি হবে।’ সিনিয়র সচিব আরও বলেন, সরকারি কর্মচারীদের চাকরিতে প্রবেশের সময় একবার পুলিশ ভেরিফিকেশন হয়। তখন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হিসাবে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান চাকরিপ্রার্থীকে চেনেন এবং জানেন বলে সত্যায়ন করেন। তবে পদোন্নতির আগে যে বিষয়ে অনুসন্ধান করা হয়, তা কখনোই পুলিশ ভেরিফিকেশন নয়। সেটা অন্য বিষয়।


শেয়ার করুন