২৯ এপ্রিল ২০২৪, সোমবার, ০৪:০৪:০৫ পূর্বাহ্ন
পলিথিন ও প্লাস্টিকের দাপটে তলানিতে পরিবেশ সংরক্ষণ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১১-০২-২০২৪
পলিথিন ও প্লাস্টিকের দাপটে তলানিতে পরিবেশ সংরক্ষণ

পরিবেশ দূষণ ত্বরান্বিত করছে পলিথিন ও প্লাস্টিক। ক্যান্ডি, বিস্কিট ও চিপসের প্যাকেট, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মিনি প্যাক শ্যাম্পু, বিভিন্ন ধরনের জুসের প্যাকেট ও বোতল, কোমল পানির পরিত্যক্ত বোতলে সয়লাব দেশের খাল-বিল, পুকুর-ডোবা, নদ-নদী এবং সাগর। দেশে ২০০২ সাল থেকে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, পরিবহণ, বিপণন এবং ব্যবহার নিষিদ্ধ। তারপরও পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার হচ্ছে হরদমে। দিন দিন পলিথিন ও প্লাস্টিক উৎপাদন বাড়ছে বৈ কমছে না। ফলে পরিবেশ সংরক্ষণ এখন তলানিতে এসে ঠেকেছে।


বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়কমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, নিঃসন্দেহে পলিথিন ও প্লাস্টিক পরিবেশের জন্য মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে এনেছে। সমস্যা হচ্ছে, যে কাঁচামাল দিয়ে পলিথিন তৈরি করা হয়, তা অন্য শিল্পেও ব্যবহৃত হয়। ফলে চাইলেই আমরা পলিথিনের কাঁচামাল আমদানি বন্ধ করতে পারি না। একবার ব্যবহারযোগ্য পরিবেশবান্ধব দ্রুত পচনশীন প্লাস্টিকের কাঁচামাল আমদানির অনুমোদন দেওয়া হবে। ধীরে ধীরে ক্ষতিকর প্লাস্টিক উৎপাদন বন্ধ করা হবে। তিনি আরও বলেন, আইন ও বিধিগত কিছু সমস্যা আছে। রয়েছে জনবল সংকটও। অভিযান পরিচালনা করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আমরা পলিথিন ও ক্ষতিকর প্লাস্টিক উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধে শিগগিরই অভিযান পরিচালনা করব। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে যে, আমরা পরিবেশ রক্ষা বা সংরক্ষণে সফল হতে পারিনি। না পারার দায় স্বীকার করা একটি বড় অর্জন বলে আমি মনে করি।


সাবের হোসেন চৌধুরী আরও জানান, পাট থেকে সোনালি ব্যাগ তৈরির কৌশল উদ্ভাবক বিজ্ঞানী মোবারক হোসেনের সঙ্গে পাটের পলিথিন উৎপাদন নিয়ে বৈঠক করবেন। যদি পরিবেশবান্ধব হয়, তাহলে সোনালি ব্যাগ উৎপাদন ও বিপণনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারের কাছে সুপারিশ পেশ করবেন।


খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর লালবাগ, কামরাঙ্গীচর ও লালবাগের চান্দিরঘাট এলাকায় প্রশাসনের নাকের ডগায় অননুমোদিত প্লাস্টিক উৎপাদন ও বিপণন হচ্ছে। ওই এলাকায় প্রকাশ্যে প্রায় ৯ শতাধিক অবৈধ পলিথিনের কারখানা রয়েছে। বিষয়টি পরিবেশ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও যুগান্তরকে নিশ্চিত করেছেন। পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবহারের ফলে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। এতে নদীদূষণ, পানি দূষণের পাশাপাশি ভরাট হচ্ছে সাগরতল। নদীর গভীরতা কমে নদী ভাঙনেরও অন্যতম কারণও এ পরিত্যক্ত পলিথিন ও প্লাস্টিক। পরিবেশ অধিদপ্তর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের গবেষণায় দেখা গেছে পলিথিন সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় সিটি করপোরেশন, জেলা শহর, পৌরসভা ও উপজেলা সদরে। ফলে শহরসংলগ্ন নদ-নদীগুলোই পলিথিন দূষণের শিকার হচ্ছে। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, বংশী, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী নদী, বরিশালের কীর্তনখোলা নদী, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ও হালদা নদীর তলদেশে পলিথিনের পুরু স্তর পড়েছে। এ কারণে নদীর দূষণ তো বটেই, জীববৈচিত্র্যও ধ্বংস হচ্ছে। পলিথিনের প্রভাবে নদীর গভীরতা কমে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে নদীতে মাছের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। বহু প্রজাতির মাছ ইতোমধ্যে হারিয়ে গেছে।


শহর কিংবা গ্রাম সর্বত্র জলাবদ্ধতা মারাত্মক সমস্যা হিসাবে দেখা দিয়েছে। শহর, গ্রামের পয়ঃনিষ্কাশনে ব্যবহৃত ড্রেন পলিথিনের কারণে বদ্ধ হয়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। ময়লার মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশ জুড়ে রয়েছে পলিথিন ও প্লাস্টিক বোতল। ঢাকার ৮০ শতাংশ ড্রেন পলিথিনে আবদ্ধ। জলাবদ্ধতায় অনেক সময় প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। অনেক সময় ড্রেনের ভেতরে পড়ে মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে। তবুও নাগরিক সচেতনতা দেখা যাচ্ছে না।


গবেষকরা বলছে, মাটির উর্বরতা নষ্ট করে ফসলের ক্ষতি করে পলিথিন। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষকরা বলছেন পলিথিন মাটির উর্বরতা শক্তি হ্রাস করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিশ্বে প্রতি চারজনের মধ্যে অন্তত একজনের মৃত্যু হয় পরিবেশ দূষণে। প্রতিবছর পৃথিবীতে বায়ুদূষণে মারা যায় প্রায় ৪২ লাখ মানুষ।


পরিবেশ অধিদপ্তরের উপরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন যুগান্তরকে বলেন, পরিবেশ সংরক্ষণ এককভাবে পরিবেশ অধিদপ্তরের কাজ না। পরিবেশ অধিদপ্তর অভিযান করবে আর নাগরিকরা পলিথিন ব্যবহার করতেই থাকবে। এ ধারণা ঠিক নয়। সব অংশীজনকে পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যবহারে সতর্ক হতে হবে। পরিবেশ অধিদপ্তর ইতোমধ্যে বেশকিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে যা সফল বাস্তবায়নে পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যবহার কমে আসবে। যারা পলিথিন ও প্লাস্টিক উৎপাদন করে তাদের বিকল্প পণ্য উৎপাদনে নিয়োজিত করার জন্য কাজ করছে পরিবেশ অধিদপ্তর।


বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) মহাসচিব শরীফ জামিল যুগান্তরকে বলেন, পুরো পৃথিবী থেকে পলিথিন ও প্লাস্টিক বাতিল করেছে বা করছে। বিশ্বের প্রথম ১০টি পলিথিন উৎপাদন ও ব্যবহারকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। সমুদ্রের তলদেশ পলিথিন প্লাস্টিকে ভরে গেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ৫০ বছর পর সমুদ্রে মাছের চেয়ে পলিথিন বেশি থাকবে। একটি পলিথিন মাটিতে পুঁতে রাখলেও নষ্ট হতে সময় লাগে প্রায় ৪শ বছর। এক কথায় পলিথিন ও প্লাস্টিক আমাদের সামগ্রিক জীবন খেয়ে ফেলছে।


সরকার পলিথিনের উৎপাদন, বিপণন, বহণ, পরিবহণ নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু বিকল্প কি ব্যবহার করতে হবে তার গাইডলাইন দেয়নি। ফলে আইন কাগজেকলমে। সব অংশীজনকে নিয়ে পলিথিন উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধের উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে। সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়কে এ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে।


বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. আফতাব আলী শেখ সম্প্রতি যুগান্তরকে বলেন, সমুদ্রের তলদেশে যে পরিমাণ পলিথিন ও প্লাস্টিক জমেছে তাতে মনে হচ্ছে আরেকটি মহাদেশের সমান হবে। আগামী দিনে সমুদ্র ভরাট হয়ে যাবে। নদনদী সমুদ্রে কোনো মাছ পাওয়া যাবে না। পরিস্থিতি থেকে উত্তোলনে পলিথিন ও প্লাস্টিক পণ্যের উৎপাদন সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। সহজে মাটিতে মিশে যায় এমন দ্রব্য উৎপাদন করতে হবে। পাটের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। পাটের ব্যাগ সহজলভ্য করতে হবে। যে কাপড়ে সিনথেটিক বেশি সে ধরনের কাপড় উৎপাদন বন্ধ করতে হবে। তিনি সতর্ক করে বলেন, যে পরিমাণ প্লাস্টিক সাগরের নিচে জমা আছে, তা কয়েকশ বছরেও শেষ হবে না। আর এই প্লাস্টিক মানুষের দেহে বিভিন্ন আকারে প্রবেশ করে ক্ষতিসাধন করছে।


শেয়ার করুন