২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ০৮:১৫:৩৬ অপরাহ্ন
লাভে বিপিসি, লাখো কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৪-০১-২০২৪
লাভে বিপিসি, লাখো কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম সহনীয় পর্যায়ে থাকায় লাভ করছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। সমৃদ্ধ হচ্ছে রাষ্ট্রীয় কোষাগারও। তবে এর সুফল পাচ্ছে না দেশের মানুষ। তাদের বাড়তি দামেই তেল কিনতে হচ্ছে।


উল্টো আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তেলের দাম নির্ধারণের পদ্ধতি চালু করার উদ্যোগ রয়েছে। এতে তেলের দাম দেশের বাজারে আরও বাড়ার শঙ্কা রয়েছে।


খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, লোকসানের কথা বলে ২০২২ সালের আগস্টে দেশে জ্বালানি তেলের দাম রেকর্ড প্রায় ৪৭ শতাংশ বাড়ানো হয়। তবে ওই অর্থবছরে (২০২২-২৩) নিট ৪ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা মুনাফা করেছে বিপিসি। এ নিয়ে গেল ৯ বছরে লাভ করেছে ৪২ হাজার ৯৩৩ কোটি টাকা। লিটারেই বিপিসির মুনাফা হচ্ছে গড়ে ১০ থেকে ১৫ টাকা।


বিপিসি শুধু নিজে লাভ করছে তা নয়, সরকারি কোষাগারেও দিচ্ছে বিপুল টাকা। গত ৯ বছরে ১ লাখ ৫৯৭ কোটি টাকা জমা দিয়েছে সংস্থাটি।


বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ব্যবসা নয়। তাই লাভের দিকে নজর না দিয়ে সাশ্রয়ী দামে জনগণকে পণ্য সরবরাহে দৃষ্টি দেওয়া উচিত। তাদের মতে, দেশে জ্বালানি তেলের দাম কমলে অনেক নিত্যপণ্যের দাম কমে আসবে, যা বর্তমানের উচ্চমূল্যের বাজারে খানিকটা স্বস্তি দিতে পারে।


দেশে জ্বালানি তেলের চাহিদা প্রায় ৯০ লাখ টন। এর মধ্যে বিপিসি আমদানি করে ৬৫ থেকে ৭০ লাখ টন। এর বাইরে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নিজেদের প্রয়োজনে ফার্নেস অয়েল আমদানি করে। সম্প্রতি বেসরকারি পর্যায়ে জ্বালানি তেল আমদানি, পরিশোধন ও বিক্রির অনুমতি দিয়েছে সরকার। বিপিসি অপরিশোধিত তেল (ক্রুড অয়েল) আমদানি করে ১৫ লাখ টন। বাকিটুকু পরিশোধিত জ্বালানি তেল। সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় ডিজেল, যা মোট সরবরাহের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। তবে লাভ বেশি আসে অকটেন, পেট্রোল আর জেড ফুয়েল বিক্রি করে। জিটুজি পদ্ধতি আর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কোম্পানির কাছ থেকে চুক্তির মাধ্যমে জ্বালানি তেল কেনে বিপিসি।


২০২২-২৩ অর্থবছরে জ্বালানি তেলের ৫৮ শতাংশ পরিবহনে, ১৮ শতাংশ বিদ্যুতে, ১৫ শতাংশ কৃষিতে, ৬ শতাংশ শিল্পে, ১ শতাংশ গৃহস্থালিতে এবং অন্য খাতে ২ শতাংশ ব্যবহার করা হয়।


বিপিসির বিপুল মুনাফা


বিপিসির আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, টানা ছয় বছর লোকসানের পর ২০১৪-১৫ সালে মুনাফা করে। গত ৯ বছরে বিপিসি ৪২ হাজার ৯৩৩ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। এর মধ্যে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তেল বেচে ৪ হাজার ২১২ কোটি টাকা লাভ হয় সংস্থাটির। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমায় ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৭ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪ হাজার ৫৫১ কোটি টাকা লাভ করে বিপিসি। এর মধ্যে ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমানো হয়।


২০১৭-১৮ অর্থবছরে মুনাফা করে ৬ হাজার ৫৩৩ কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সংস্থাটির লাভ কমে ৩ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকায় নেমে আসে। করোনা মহামারির সময় বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমা শুরু করে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিপিসির লাভ হয় ৫ হাজার ৬৫ কোটি টাকা।


মহামারির কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম রেকর্ড পরিমাণ কমায় ২০২০-২১ অর্থবছরে সংস্থাটির মুনাফা আসে ৯ হাজার ৯২ কোটি টাকা। মহামারির পর জ্বালানি তেলের বাজার চড়া হতে থাকে বিশ্বজুড়ে। এতে ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা লোকসান করে সংস্থাটি।


২০২২ সালের জুনে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম পৌঁছায় ১২২ দশমিক ৭১ মার্কিন ডলারে। এর পর তেলের দাম কমতে শুরু করে। তবে লোকসানের কথা বলে সে বছরের আগস্টে দেশের বাজারে তেলের দাম রেকর্ড ৫০ শতাংশ বাড়ানো হয়। সমালোচনার মুখে আগস্টেই তেলের দাম নামমাত্র (লিটারে ৫ টাকা) কমানো হয়। 


লাভের টাকা নিচ্ছে সরকারও


ভ্যাট, ট্যাক্স, লভ্যাংশ, উদ্বৃত্ত মিলিয়ে গত অর্থবছরে ১৫ হাজার ৪৯২ কোটি টাকা সরকারি তহবিলে জমা দিয়েছে বিপিসি। ২০২১-২২ অর্থবছরে বিপিসি লোকসান করলেও রাষ্ট্রীয় কোষাগারে দিয়েছে ১৫ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা। 

তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৫ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৪ হাজার ১৪৬ কোটি, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৯ হাজার ৫৯০ কোটি, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৯ হাজার ৯৭ কোটি, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৯ হাজার ২৪৮ কোটি, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৬ হাজার ২১৯ কোটি, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৫ হাজার ২২৯ কোটি টাকা সরকার নিয়েছে বিপিসি থেকে। 


জনগণ পাচ্ছে না সুফল


কয়েক মাস ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৭০ থেকে ৮০ ডলারের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। দাম কম থাকায় লাভ করছে বিপিসি। তবে জনগণকে আগের বাড়তি দামেই জ্বালানি তেল কিনতে হচ্ছে। গত শুক্রবার বিশ্ববাজারে ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ছিল প্রতি ব্যারেল ৮০ দশমিক ৬৫ ডলার আর মারবান ক্রুড ছিল ৮০ দশমিক ৩৭ ডলার। 


জানতে চাইলে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, লোকসানের কথা বলে দাম বাড়িয়ে জনগণের পকেট কাটা হয়। ট্যাক্স-ভ্যাটের নামেও টাকা নেওয়া হচ্ছে। সরকারও লাভ করছে, বিপিসিও লাভ করছে। তবে জনগণ কিছু পাচ্ছে না। 


তিনি বলেন, বিপিসির আর্থিক স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো বিশ্বমানের অডিট প্রতিষ্ঠান দিয়ে বিপিসির আর্থিক নিরীক্ষার দাবি জানিয়ে আসছে বহুদিন ধরে। তবে তা আমলে নেয় না বিপিসি। শামসুল আলম বলেন, অর্থনীতির সংকটময় পরিস্থিতিতে সরকারের উচিত ছিল জনগণের কথা ভেবে তেলের দামে ছাড় দেওয়া।


দাম বরং বাড়তে পারে


ঋণের শর্ত হিসেবে জ্বালানি তেলে ভর্তুকি তুলে দেওয়ার শর্ত দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তেলের দাম প্রতি মাসে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমন্বয় করতে বলেছে সংস্থাটি। গত ডিসেম্বর থেকেই এ পদ্ধতি চালু করতে বলেছিল আইএমএফ। জাতীয় নির্বাচন থাকায় সরকার স্বয়ংক্রিয় দাম বাড়ানোর ফর্মুলা চূড়ান্ত করেনি। আগামী ফেব্রুয়ারি কিংবা মার্চে তা চালু হতে পারে। প্রস্তাবনাটি চূড়ান্ত করতে বর্তমানে অর্থ ও জ্বালানি বিভাগ আলোচনা করছে।


বিপিসির প্রস্তাব অনুসারে, এ পদ্ধতিতে প্রথম দিকে প্রতি মাসে একবার দাম সমন্বয় হবে। ভ্যাট, ট্যাক্স, বিভিন্ন কমিশন, চার্জ– এগুলো নির্দিষ্ট রেখে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তেলের দর ওঠানামা করবে।

স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতেও দেশে তেলের দাম না কমে বরং বাড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ, সরকারের ভ্যাট-ট্যাক্সের পাশাপাশি ১০ শতাংশ মুনাফা দাবি করেছে বিপিসি। এতে আগের মতোই জনগণের পকেট কেটে মুনাফার পরিকল্পনা করছে সংস্থাটি– অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।


এ ব্যাপারে বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ মন্তব্য করতে রাজি হননি। সংস্থাটির পরিচালক (বিপণন) অনুপম বড়ুয়া বলেন, সরকার যেভাবে চাইবে, সেভাবেই দাম নির্ধারিত হবে।


শেয়ার করুন