২৯ এপ্রিল ২০২৪, সোমবার, ০৭:৩৭:০০ পূর্বাহ্ন
তুলনামূলক নিরাপদ বাহন রেল হয়ে উঠছে ঝুঁকিপূর্ণ ও আতঙ্কের কারণ।
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৭-১২-২০২৩
তুলনামূলক নিরাপদ বাহন রেল হয়ে উঠছে ঝুঁকিপূর্ণ ও আতঙ্কের কারণ।

তুলনামূলক নিরাপদ বাহন রেল হয়ে উঠছে ঝুঁকিপূর্ণ ও আতঙ্কের কারণ। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো স্থানে দুর্বৃত্তরা নাশকতার চেষ্টার করছে কিংবা দুর্ঘটনা ঘটছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে রেললাইন কেটে ফেলা কিংবা ট্রেনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটছেই। পাশাপাশি ককটেল বিস্ফোরণের মতো ঘটনাও অহরহ ঘটছে।


এমন পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে রাতের বেলায় চলাচল করে এমন ১০টি ট্রেনের যাত্রা বাতিল ও সীমিত করে ফেলেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এখানেই শেষ নয়, লাইনচ্যুতির ঘটনায় যাত্রাবিলম্বও বাড়ছে। তাছাড়া ট্রেনের সঙ্গে সড়কযানের ধাক্কা নিয়মিত বিষয় হয়ে উঠেছে রেলে। সর্বশেষ গতকাল মঙ্গলবার কমলাপুর স্টেশনের প্ল্যাটফরমে রেললাইন থেকে সরে যায় একটি আন্তঃনগর ট্রেনের চাকা, যাতে বিড়ম্বনায় পড়েন যাত্রীরা। ফলে রেলে যেন শনির দশা ভর করছে।


জানা গেছে,  রাজধানীর কমলাপুর প্ল্যাটফরম থেকে রওনা হওয়ার সময় পঞ্চগড়গামী একতা এক্সপ্রেসের চারটি চাকা লাইন থেকে বেরিয়ে যায়। ঘটনাটি সকাল ১০টা ১০ মিনিটের। আড়াই ঘণ্টা পর ট্রেনটি ছেড়ে যায়। এ দীর্ঘ সময় যাত্রীদের অপেক্ষা করতে হয়েছে। এর আগের দিন সোমবার সকালে ঢাকার উত্তরার আবদুল্লাহপুরে মালবাহী ট্রেনের পাঁচটি বগি লাইনচ্যুত হয়।


একইদিনে ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জে একটি রেলক্রসিংয়ে ট্রাকে ট্রেনের ধাক্কায় ৪ জন নিহত হন। এগুলো এখন প্রায় নিয়মিত ঘটনা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গত ৩০ অক্টোবর থেকে নাশকতা। জানা গেছে, ৩ হাজার ২০০ কিলোমিটার রেলপথ পাহারা দেওয়া চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ দেশব্যাপী রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। বড় ক্ষতির শিকার সরকারি গণপরিবহন ট্রেন।


২০১৪ সালে নির্বাচনের আগে যেভাবে নাশকতা চালানো হয়, একই কায়দায় এখন রেললাইন উপড়ে ফেলা বা কেটে ফেলা, ফিশপ্লেট খুলে ফেলা হচ্ছে। এছাড়া ককটেল বিস্ফোরণ, অগ্নিসংযোগ ও পাথর নিক্ষেপের ঘটনাও রয়েছে। এর জেরে হতাহতের ঘটনাও ঘটছে। এ অবস্থায় ট্রলি, গ্যাং কার ও লোকোমোটিভ দিয়ে সামনের পথ এসকর্ট ও রেকি করার কাজ চলমান।


কুয়াশা ও রাতের কারণে গতি কমানোর নির্দেশ রয়েছে। তবুও পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় রাতের বেলায় চলাচল করা ৪ জোড়া ট্রেনের যাত্রা স্থগিত করা হয়। আরও এক জোড়া ট্রেনের যাত্রা সংক্ষিপ্ত করা হয়। উদ্দেশ্য- মানুষের যাতায়াত নির্বিঘ্ন করা।


বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক কামরুল আহসান বলেন, রেলওয়ের নিরাপত্তায় রেলওয়ে পুলিশ, আরএনবি, আনসারসহ বিভিন্ন বাহিনী অত্যন্ত সতর্ক। সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দিয়েই ট্রেন পরিচালনা করা হচ্ছে। যাত্রীদের আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। বরং নিরাপত্তার স্বার্থেই একেবারের কম প্রয়োজনীয় ট্রেন বন্ধ রাখা হয়েছে। আর রেলপথের লাইনচ্যুতি এড়াতে রক্ষণাবেক্ষণে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। লেভেলক্রসিং গেটে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। যাতে করে ট্রেনের সঙ্গে বাস, ট্রেন বা অন্য বাহনের কোনো ধাক্কা না লাগে।


জানা গেছে, ২০১৪ সালে নির্বাচনের আগে ট্রেন পুড়িয়ে দেওয়া এবং রেললাইন উপড়ে ফেলার ঘটনায় রেলের ক্ষতি হয়েছে ৭০ কোটি টাকা। এবারও সেই অপ্রত্যাশিত ধারাবাহিকতা। রেলওয়ে প্রথম বড় নাশকতার শিকার ৩১ অক্টোবর। প্রায় প্রতিদিনই নাশকতার খবর আসছে। নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা ‘মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস’ ভোর চারটার দিকে ভয়াবহ নাশকতার শিকার হয়। ওই সময় গাজীপুরের ভাওয়াল রেলওয়ে স্টেশন পার হওয়ার পর বনখড়িয়া এলাকার সেতুর অদূরে বিকট শব্দে ট্রেনের ইঞ্জিন লাইনচ্যুত হয়। এতে ইঞ্জিনসহ ১৪ কোচের (বগি) সাতটিই রেললাইন থেকে ছিটকে পড়ে। দুর্বৃত্তরা বনের মধ্যে রেলপথের ২০ ফুট কেটে রাখলে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এ নাশকতায় যাত্রীবাহী ট্রেনের একজন নিহত ও ১১ জন আহত হয়। ওই ঘটনায় পুরো দিন লেগে যায় রেলপথটি চলাচলের উপযোগী করতে।


পরের দিন রাতে নীলফামারীর ডোমারে রেললাইনের ফিশপ্লেট ক্লিপ খুলে নাশকতার চেষ্টা করেছে দুর্বৃত্তরা। তবে এলাকাবাসী এগিয়ে আসায় বড় দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায় চিলাহাটি-খুলনাগামী সীমান্ত এক্সপ্রেস ট্রেন। এর কিছুক্ষণের মধ্যে আসা খুলনাগামী সীমান্ত এক্সপ্রেস ট্রেনটিকে এলাকাবাসী বিভিন্ন সংকেত দিয়ে থামাতে সক্ষম হন। এরপর রেলের লোকজন এসে রেললাইন মেরামত করলে ট্রেনটি ছেড়ে যায়। এরপর রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সেই মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের তিনটি কোচ পুরোপুরি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আরেকটি আংশিক পুড়ে গেছে। চারজনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে কোলের শিশুকে জড়িয়ে নাশকতার আগুনে পুড়ে মা-সন্তানের মৃত্যু গোটা বিশ্ববাসীকে নাড়া দেয়।


রেলওয়ে থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, গত ৩১ অক্টোবর ঢাকা কমিউটার ট্রেন রাত সাড়ে ১১টার দিকে এলোপাতাড়ি পাথর নিক্ষেপের শিকার হয়। এতে ১৮ হাজার ২৪৩ টাকার ক্ষতি হয়। পরদিন ১ নভেম্বর বাংলাদেশ-ভারত রুটে চলাচলকারী মৈত্রী এক্সপ্রেসে পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করা হয়। একইদিনে অবরোধকারীরা মৈত্রী এক্সপ্রেসে পাথর নিক্ষেপের ফলে একটি জানালার গ্লাস ভেঙে যায়। ঈশ্বরদী ওয়াশপিট লাইনে অবস্থানকালে ট্রেনে অগ্নিসংযোগ করে ঈশ^রদীতে। একইদিনে জয়দেবপুর-মৌচাক স্টেশন এলাকায় ককটলে বিস্ফোরণ ও ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ এবং সিগন্যালের টাইরড চুরিসহ জয়েন্টের নাটবল্টু খোলা হয়। একইদিনে নন্দনগাছি-সরদহ এলাকায় গ্যাস সিলিন্ডার দিয়ে ব্রিজ সিøপারে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এছাড়া রেললাইনে টায়ার জ্বালিয়ে আগুন দেওয়ায় ৯টি লাইনার ও ৯টি রাবার প্যাড পুড়েছে মৌচাক-হাইটেক সিটি এলাকায়। ১৬ নভেম্বর টাঙ্গাইল স্টেশনে টাঙ্গাইল কমিউটার ট্রেনের কোচে আগুন দেওয়া হয়। ২১ নভেম্বর জয়দেবপুর-মৌচাক এলাকার ১১ নম্বর ব্রিজের স্লিপারে আগুন দেওয়া হয়। রেলের বিয়ারিং প্লেট, ডগ স্মাইক, ইআরসি, অর্ডিনারি সিøপারের ক্ষতি করে যাচ্ছে নিয়মিত।


কেবল দূর-দূরান্তে নাশকতার চেষ্টা চলছে এমনটি নয়। গত ২৮ অক্টোবর ঢাকা কমলাপুর স্টেশনের প্রজেক্ট অফিসের সামনে রাত পৌনে ১টার দিকে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। ৩০ অক্টোবর জয়দেবপুরে রেললাইনে আগুন লাগানো হয়।


বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে ৫২ ও পশ্চিমাঞ্চল ৫৬টি আন্তঃনগর ট্রেন চলাচল করে। বাংলাদেশ-ভারত রুটে চলাচলরত আন্তঃদেশীয় ৩ জোড়া অর্থাৎ ৬টি ট্রেন চলে। এছাড়া লোকাল, মেইল, কমিউটার ট্রেন পশ্চিমাঞ্চলে চলে ৭০টি এবং পূর্বাঞ্চলে ৬৮টি। এছাড়া পূর্বাঞ্চলের আওতায় ৮টি কনটেইনার ট্রেন চলে। আরও ২৫টি ট্রেন চলাচল করছে বিভিন্ন তেলবাহী ও পণ্যবাহী হিসেবে। এসব বাহনের কোনোটি নাশকতার ঝুঁকিতে; কোনোটি আছে লেভেল রেলক্রসিং সড়কযানের সঙ্গে ধাক্কা লেগে লাইনচ্যুত হওয়ার ঝুঁকিতে।


শেয়ার করুন