৩০ এপ্রিল ২০২৪, মঙ্গলবার, ১২:৩০:০৮ পূর্বাহ্ন
নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে সামাজিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার দাবিতে রাজশাহীতে সমাবেশ
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৯-১২-২০২৩
নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে সামাজিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার দাবিতে রাজশাহীতে সমাবেশ

আর্ন্তজাতিক মানবাধিকার দিবস ২০২৩ উৎযাপন উপলক্ষে রাজশাহীতে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।

শনিবার মহানগরীর বেলদারপাড়া এলাকায় এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত ঞয়। বিডব্লুজিইডি, ক্লীন এবং পরিবর্তনের যৌথ আয়োজনে এ সমাবেশে আলোচনা করেন অগ্নি প্রকল্পের সমন্বয়কারি হাসিবুল হাসান, সচেতনের সমন্বয়কারি মাহামুদ উন নবী ।


আলোচনায় বক্তারা বলেন; মানবাধিকার যেকোনো মানুষের অবিচ্ছেদ্য অধিকার। নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে এবং যথাযথ প্রক্রিয়া অনুযায়ী ব্যতীত এই অধিকার হরণ করা যায় না। সমস্ত মানবাধিকার অবিভাজ্য এবং পরস্পর নির্ভরশীল। এর অর্থ হল; এক ধরনের অধিকার অন্যটি ছাড়া সম্পূর্ণরূপে উপভোগ করা যায় না।


সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, বন্যা, তাপপ্রবাহ, খরা, মরুকরণ, পানির ঘাটতি এবং গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সংক্রামক রোগের বিস্তারকে জলবায়ু পরিবর্তনের কিছু বিরূপ প্রভাব হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই ঘটনাগুলি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সারা বিশ্বে মানবাধিকারকে হুমকির মুখে ফেলে, যার মধ্যে রয়েছে জীবনের অধিকার, নিরাপদ পানীয় জল এবং স্যানিটেশন, খাদ্য, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, আত্মনিয়ন্ত্রণ, সংস্কৃতি, কাজ এবং উন্নয়ন।


বাংলাদেশের মতন উন্নয়নশীল দেশ সহ পৃথিবীর বেশিরভাগ উন্নত দেশগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করছে। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো অনেকক্ষেত্রেই পরিবেশের ক্ষতি করার সাথে সাথে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। স্থানীয় মানুষ থেকে শুরু করে এখানে কর্মরত শ্রমিকেরা নানান ভাবে মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।


উদাহরনস্বরূপ, মেঘনাঘাট ৫৮৪ মেগাওয়াট এলএনজি বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ৩৫০ জন বাসিন্দার কাছ থেকে নেয়া ২১.০৭ একর জমিতে নির্মিত বলে নথিপত্রে উল্লেখ আছে। কিন্তু বাস্তব চিত্রটা ভিন্ন, বিদ্যুৎকেন্দ্রের নেয়া মোট জমির পরিমাণ কমপক্ষে ২৭.৯৫ একর। এর মানে অন্তত ৬.৮৮ একর (৩২.৭%) জমি অবৈধভাবে নেওয়া হয়েছে।


এরমধ্যে মেঘনা নদী থেকেই নেওয়া হয়েছে অন্তত ৩.৪১ একর। জমি ক্রয়ের ক্ষেত্রে কোনো নিয়ম কানুনই মানা হয়নি। স্থানীয় জমির মালিকেরা প্রতি শতক ৪.৫৮ লাখ টাকা গড় হারে মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে তাদের জমি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু এই মধ্যস্বত্বভোগীরাই একই জমি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছে প্রতি শতক ৯.১৫ লাখ টাকা হারে বিক্রি করেছে।


সে হিসেবে, স্থানীয় জমির মালিকরা মধ্যস্বত্বভোগীদের দ্বারা প্রতারিত হয়েছেন কমপক্ষে ৯৬.২২ কোটি টাকা, যা সুষ্পষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘনের পর্যায়ে পড়ে। বে-আইনী জমি অধিগ্রহণের কারণে কিছু পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং তাদের মধ্যে কৃষক এবং মৎস্যজীবী থেকে শুরু করে অনেকেই তাদের পেশা বদলাতে বাধ্য হয়েছে । বালি দিয়ে ভরাট করার কারণে স্থানীয় মানুষের বাসস্থান ও চাষযোগ্য জমি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।


এছাড়াও পটুয়াখালি ১,৩২০ মেগাওয়াট কয়লা-ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র (আরএনপিএল) কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য অন্তত ১,২০০ পরিবারের ১,০০২ একর ফসলি জমি ও বাড়ি অধিগ্রহণ করে এই তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। এই জমি অধিগ্রহণ বাবদ ৭৬ কোটি টাকা মূল্য নির্ধারণ করা হলেও সেখানে এখন পর্যন্ত মাত্র ১৮ কোটি ৭৬ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।


টাকা পরিশোধ ছাড়াই স্থানীয় লোকদের জমি ভরাট করে সেখানে স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগের ভিত্তিতে জানা যায়, এখানে জমি অধিগ্রহণের জন্য একটি পরিবারকে উচ্ছেদ করতে মধ্যরাতে ড্রেজার দিয়ে তাদের বাড়ির ওপর বালি ফেলে তাদেরকে হত্যা চেষ্টা করা হয়।পরবর্তিতে স্থানীয়দের সাহায্যে তদের উদ্ধার করা হয়।


বিদ্যুৎ সেক্টরে শ্রমিকদের দাবি ক্ষুণ্ণ এবং সবচেয়ে বেশী মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে চট্টগ্রামের বাঁশখালির বিদ্যুৎকেন্দ্রে। এস আলম গ্রুপ ও চীনের সেপকো ও এইচ টিজি গ্রুপের মালিকানাধীন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি প্রদানসহ বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ করতে গিয়ে ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত পুলিশের গুলিতে ১২ জন নিহত হয়েছেন।


এছাড়াও, বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র যেমন রূপসা ৮০০ মেগাওয়াট প্লান্টের শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এখানে তাদের কর্মপরিবেশ একেবারেই অনূকুল না। তারা নিজেদের সুরক্ষা সরঞ্জাম বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পায় না, নিজেদের সংগ্রহ করতে হয়। এছাড়াও যে মেডিকেল সেন্টার আছে কেন্দ্রের ভেতরে তা শুধুমাত্র চীনা শ্রমিকদের সেবা দেওয়ার জন্য। স্থানীয় শ্রমিকদের যেকোনো দূর্ঘটনায় অঙ্গহানি হলেও প্রাথমিক চিকিৎসা ছাড়া আর কিছুই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে দেওয়া হয় না।


এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কারণে স্থানীয় পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮(ক)১ এর দ্বিতীয়ভাগে বলা আছে, “পরিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়নঃ রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব-বৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণির সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।” অর্থাৎ এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে রাষ্ট্রের মূলনীতি লঙ্ঘন হচ্ছে।


বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৫০.৪% নারী, যারা বেশিরভাগ গৃহকর্ম এবং কৃষিতে নিয়োজিত। বাংলাদেশের স্থানীয় সংস্কৃতি অনুযায়ী, নারীরা রান্না-বান্না, শিশু এবং বড় পরিবারের সদস্যদের যত্নে সরাসরি নিযুক্ত থাকেন। ফলস্বরূপ, তারা পরিবারের প্রয়োজনেই সর্বোচ্চ পরিমাণ জ্বালানী ব্যবহার করে। জ্বালানী ক্ষেত্রে নারীরা মারাত্মকভাবে অবহেলিত। যেমন, পরিকল্পনা থেকে বাস্তবায়ন, এবং বিতরণ কোথাওই তাদের অংশগ্রহণ উল্লেখ করার মতন না। মাত্র ২%-৪% হিসাবে জমির মালিকানা নারীদের হাতে থাকায়, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিকেরা নারীদের উপস্থিতি, তথ্য অধিকার এবং পরামর্শ গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণকে উপেক্ষা করে যায়।


প্রকল্প পরিচালনাকারীরা, সবসময় নারীদের বিশেষ চাহিদা উপেক্ষা করে যেমন, প্রজনন স্বাস্থ্য। একটি গবেষণায় দেখা যায় যে বাংলাদেশের জীবাশ্ম জ্বালানির কোম্পানিগুলোতে মাত্র ৮.৩% শ্রমিক নারী এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায়ে আছেন মাত্র ০.৯৩% নারী। অর্থাৎ একটি দেশের অর্ধেকের বেশি জনসংখ্যার জ্বালানীক্ষেত্রে অংশগ্রহণ একেবারে নামমাত্র। এই বিরাট জনগোষ্ঠির সরাসরি অংশগ্রহণ ছাড়া দেশের উন্নয়ন প্রায় অসম্ভব।


এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি এবং নির্মাণ চলাকালীন সময়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে এসব এলাকার নারীরা অথচ তারাই সবচেয়ে বেশি জ্বালানি ব্যবহার করছে। তারা যেমন জমি অধিগ্রহণের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে তেমনি পরিবেশের ওপর এর বিরূপ প্রভাবের জন্য সবচেয়ে বেশি অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে।


বক্তারা তাদের বক্তবের মাধ্যমে ১২ টি দাবি তুলে ধরেন (১) কৃষিজমি বা বাস্তভিটায় কোন ভাবেই কোন জ্বালানি প্রকল্প গ্রহন করা যাবে না। সাধারণ মানুষকে তার বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ করা যাবে না। (২)ইতোমধ্যে যাদের ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, তাদের জায়গায় গৃহিত প্রকল্পের লভ্যাংশ তাদেরকে নিয়মিত দিতে হবে।


(৩) বিদ্যুৎকেন্দ্র সংক্রান্ত যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে নির্মাণের পূর্বেই স্থানীয়দের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, তাদের মতামতের গুরুত্ব দিতে হবে। (৩)ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া, ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ ও বিতরণ এবং ক্রয় সংক্রান্ত কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।(৪) প্রকল্প বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে সংঘটিত দুর্নীতির তদন্তপূর্বক সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।


(৫) সকল বিদ্যুৎকেন্দ্রে শ্রমিকদের ন্যায্য দাবী বাস্তবায়ন করে তাদের মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। (৬) স্থানীয় পরিবেশের ক্ষতি করে কোনো প্রকল্প গ্রহণ করা যাবেনা। (৭) নারী অধিকার রক্ষায়, যে-কোন জ্বালানি প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা কমিটিতে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ নারী সদস্য মনোনীত করতে হবে।


(৮) দীর্ঘ মেয়াদি প্রকল্পের ক্ষেত্রে ভূমি ইজারা নিতে হবে এবং জমির বার্ষিক ভাড়া প্রদানের সুষ্পষ্ট নীতিমালা তৈরি করতে হবে। (৯) কৃষিভিত্তিক সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনে অর্থায়ন করতে হবে।

শেয়ার করুন