২৯ এপ্রিল ২০২৪, সোমবার, ০১:০৯:২৯ পূর্বাহ্ন
২৮ অক্টোবরের সহিংসতা: পুলিশের চোখ-ক্যামেরা দেখল না দুর্বৃত্তদের
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৩-১১-২০২৩
২৮ অক্টোবরের সহিংসতা: পুলিশের চোখ-ক্যামেরা দেখল না দুর্বৃত্তদের

বিএনপির মহাসমাবেশের দিনে আশপাশে মোতায়েন ছিল বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্য। সঙ্গে ছিল ভিডিও ও শরীরের সঙ্গে ঝোলানো বিশেষ (বডি ওর্ন) ক্যামেরা। এরপরও সেদিন তাণ্ডব চালানো দুর্বৃত্তদের কাউকে দেখেননি বলে দাবি করেছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। শুধু তা-ই নয়, দুর্বৃত্তদের কোনো চেহারাও ধরা পড়েনি পুলিশের ক্যামেরাগুলোতে। এখন প্রশ্ন উঠেছে, এত পুলিশের চোখ-ক্যামেরা দুর্বৃত্তরা এড়াল কীভাবে? কেউ কেউ বলছেন, ঘটনার সময় পুলিশ সদস্যরা নিরাপদ অবস্থানে ছিলেন। আর এখন দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ উঠতে পারে ভেবে হামলাকারীদের না দেখার কথা বলছেন।


তবে ঘটনাস্থলে থাকা পুলিশ কর্মকর্তারা আজকের পত্রিকাকে বলছেন, চোরাগোপ্তা হামলা করা দুর্বৃত্তদের তাঁরা দেখতে পাননি। অগ্নিসংযোগের খবর পেয়ে তাঁরা ঘটনাস্থলে গেছেন।


ঢাকা মহানগর পুলিশের কর্মকর্তারা অবশ্য সেদিনের আগুন-ভাঙচুরের ঘটনাকে পুলিশের অবহেলা বা দুর্বলতা হিসেবে দেখতে নারাজ। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) ড. খ. মহিদ উদ্দিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, সব জায়গায় হামলাকারীরা চোরাগোপ্তা হামলা করেছে। তাই কাউকে দেখতে পাওয়া যায়নি বা তাৎক্ষণিক শনাক্ত করা যায়নি। 


গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশের দিন সংঘর্ষের সময় রাজধানীর ২০টি স্থানে তাণ্ডব চালানো হয়। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয় ৩টি বাসসহ ২৫টি যানবাহন ও ৮টি ট্রাফিক পুলিশ বক্স। প্রধান বিচারপতির বাসভবন, জাজেস কোয়ার্টার, রাজারবাগে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালসহ বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা ও ভাঙচুর করা হয়। ফকিরাপুলে পিটিয়ে হত্যা করা হয় পুলিশ সদস্য আমিরুল ইসলামকে। এসব ঘটনায় বিএনপির শীর্ষ নেতাদেরসহ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। নাশকতার অভিযোগে করা এসব মামলায় গত বুধবার পর্যন্ত বিএনপির কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতাসহ ১ হাজার ৩৪৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।


ডিএমপি সূত্র বলছে, নাশকতা ঠেকাতে ২৮ অক্টোবর রাজধানীতে ৭ হাজার ২২ জন পুলিশের নিরাপত্তাবেষ্টনী তৈরি করা হয়েছিল। পুলিশ সদস্যদের ১০টি সেক্টরে ভাগ করে প্রতিটি স্থানের জন্য আলাদা দল করে দেওয়া হয়েছিল। দলের সঙ্গে ছিল দাঙ্গা দমনের সরঞ্জাম, ভিডিও ও স্থিরচিত্র ধারণের ক্যামেরা। কিন্তু এত কিছুর পরও সেদিন নাশকতা ঠেকানো যায়নি।


২৮ অক্টোবর পুলিশের প্রস্তুতিতে কোনো ঘাটতি ছিল কি না, এ প্রশ্নের জবাবে পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন গত বুধবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আহত পুলিশ সদস্যদের দেখতে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের ব্যবস্থার কোনো ঘাটতি ছিল না। সে জন্য নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছি।’


প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, ২৮ অক্টোবর সবচেয়ে বড় হামলা হয় নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের অল্প দূরে রাজারবাগে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের সামনে। পুলিশ-বিএনপি সংঘর্ষের মধ্যে বেলা সাড়ে ৩টার দিকে হাসপাতাল চত্বরে ঢুকে হামলাকারীরা ঘণ্টাখানেক তাণ্ডব চালিয়ে ২টি অ্যাম্বুলেন্স, ১টি মাইক্রোবাস ও ১৬টি মোটরসাইকেলে আগুন দেয়।


ডিএমপি সূত্র জানায়, ওই সময় হাসপাতাল মোড়ে পুলিশ দলের দায়িত্বে ছিলেন তেজগাঁও জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) এনামুল হক মিঠু। এই দলে ছিল তিন প্লাটুন পুলিশ, একটি সাঁজোয়া যান, তিনটি বডি ওর্ন ক্যামেরা।


জানতে চাইলে এডিসি এনামুল হক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ওই সময় তাঁর দল পল্টন থানার সামনে ছিল। কারণ, সেখানে বড় হামলার আশঙ্কা ছিল। হাসপাতালে হামলার খবর পেয়ে তাঁরা দ্রুত গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। সেই কারণে অগ্নিসংযোগকারীদের দেখতে পাননি।


ওই দিন প্রথম সংঘর্ষ হয় বেলা ১১টার দিকে কাকরাইল মসজিদ মোড় এলাকায়। আওয়ামী লীগের শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশে যোগ দিতে যাওয়া নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষের একপর্যায়ে কাকরাইল মসজিদের উল্টো দিকে বেলা ১১টা ২০ মিনিটে বৈশাখী পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা চলে যাওয়ার পর বিএনপির নেতা-কর্মীরা বেলা ১টার দিকে কাকরাইল গির্জার সামনে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়লে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে। একপর্যায়ে বেলা দেড়টার দিকে কাকরাইলে আইডিইবি ভবনের নিচে দুটি গাড়িতে ও জাজেস কমপ্লেক্সের সামনে ট্রাফিক পুলিশ বক্সে অগ্নিসংযোগ এবং জাজেস কমপ্লেক্স, প্রধান বিচারপতির বাসভবন, অডিট ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনায় ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে দুর্বৃত্তরা। ২টার দিকে কাকরাইল মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ বক্সে আগুন দেওয়া হয়।


মহানগর পুলিশের নথিতে দেখা গেছে, ওই সড়কে সকাল ৯টা থেকে নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল পুলিশের তিনটি দল। প্রধান বিচারপতির বাসভবনের সামনে দুই প্লাটুন পুলিশ, একটি ভিডিও ক্যামেরা, একটি স্টিল ক্যামেরা ও দুটি বডি ওর্ন ক্যামেরা নিয়ে নেতৃত্বে ছিলেন ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি উত্তর) আরিফুল ইসলাম। কাকরাইল সড়কের পূর্ব পাশে রাজমণি মোড়ে তিন প্লাটুন পুলিশ ও তিনটি বডি ওর্ন ক্যামেরা থাকা দলটির নেতৃত্বে ছিলেন ডিবির এডিসি (লালবাগ) রাকিবুল হাসান। কাকরাইল মোড়ে দুই প্লাটুন পুলিশ ও দুটি বডি ওর্ন ক্যামেরা নিয়ে ছিলেন এডিসি জুয়েল রানা ও সহকারী কমিশনার (এসি) নাজমুল ইসলাম।


ঘটনার ব্যাপারে জানতে চাইলে এডিসি আরিফুল আজকের পত্রিকাকে বলেন, প্রধান বিচারপতির বাসভবনের সামনে হামলা থামিয়ে ফিরতেই দেখেন বাস ও ট্রাফিক পুলিশ বক্স জ্বলছে। কারা আগুন দিয়েছে দেখতে পাননি। এডিসি রাকিবুল বলেন, খবর পেয়ে আইডিইবি ভবনে গিয়ে দেখেন, মূল ফটক ভেঙে দুটি মাইক্রোবাসে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। কারা করেছে বুঝতেও পারেননি। আর এসি নাজমুল বলেন, ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে তদন্ত করা হচ্ছে।


পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, সেদিন বেলা সোয়া ৩টায় নয়াপল্টনে বিএনপির মহাসমাবেশ থেকে আসা হামলাকারীরা শান্তিনগর পুলিশ বক্সে আগুন দেয়। ওই সময় পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ হয়। শান্তিনগর মোড়ে এক প্লাটুন পুলিশ, একটি বডি ওর্ন ক্যামেরাসহ ছিলেন ডিবির (তেজগাঁও) এসি রাকিবুল হাসান ভূঞা। তিনি সেখানে থাকার কথা জানিয়ে আজকের পত্রিকাকে বলেন, ঘটনার বিষয়ে বক্তব্য দেওয়ায় নিষেধ আছে।


সেদিন শান্তিনগর মোড়ে দুই প্লাটুন পুলিশ, দুটি ক্যামেরাসহ দায়িত্বে থাকা বিমানবন্দর জোনের এডিসি সাইফুল আলম মুজাহিদি বলেন, চারদিক থেকে দুর্বৃত্তরা হামলা করে। কীভাবে কী হয়েছে বোঝা যায়নি। সংঘর্ষের সময় কাউকে আটকও করা যায়নি।


বেলা ৩টা ৪০ মিনিটে মালিবাগ মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ বক্সে অগ্নিসংযোগ করা হয়। সেখানে দায়িত্বে ছিলেন এডিসি (প্রকিউরমেন্ট ও ওয়ার্কশপ) মো. শাহ কামাল। তাঁর দলের সঙ্গে থাকা দুটি বডি ওর্ন ক্যামেরায় কী ঘটনা ধরা পড়েছে, এ প্রশ্নে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে অপারগতা জানিয়ে ডিএমপির মিডিয়া শাখায় যোগাযোগের পরামর্শ দেন।


সূত্র জানায়, ফকিরাপুল থেকে দৈনিক বাংলা মোড় পর্যন্ত তিন উপকমিশনারের নেতৃত্বে মোতায়েন ছিল ১০ প্লাটুন পুলিশ। বিকেলে সংঘর্ষের সময় দলছুট হয়ে পড়া ওই প্লাটুনের সদস্য কনস্টেবল আমিরুল ইসলামকে কালভার্ট রোডে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। সেখানে দায়িত্বে থাকা মিরপুর বিভাগের ডিসি জসীম উদ্দিন মোল্লা এ বিষয়ে কিছু বলতে চাননি। তবে সিটি ইন্টেলিজেন্সের ডিসি মাহমুদুল হাসান বলেন, তিনি ঘটনাস্থলে ছিলেন না। তাঁর দল তখন রাজারবাগের ভেতরে ডিউটিতে ছিল।


সেদিন বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে কাকরাইলে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের সামনে আছিয়া পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, পুড়তে থাকা বাসটির পাশেই রাস্তায় বসে কান্নারত চালক মনির হোসেন বলছেন, ডিবি লেখা জ্যাকেট পরা দুই যুবক বাসে পেট্রল ছিটিয়ে আগুন দিয়েছেন।


তবে ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ বলেন, ডিবির নয়, ‘প্রেস’ লেখা ভেস্ট বা জ্যাকেট পরে ওই বাসে আগুন দিয়েছেন রবিউল ইসলাম নয়ন। তিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের সদস্যসচিব।


বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন থাকার পরও তাণ্ডব ঠেকাতে না পারার পেছনে কোনো অবহেলা বা গাফিলতি থাকতে পারে কি না, এমন প্রশ্নে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক বলেন, পুরো নিরাপত্তাব্যবস্থার মধ্যেও কিছু ফাঁকফোকর থাকে। সেখান দিয়েই চোরাগোপ্তা হামলা হয়। তারপরও পুলিশ সদস্যদের চোখ-কান খোলা রেখে দায়িত্ব পালন করতে হবে।


শেয়ার করুন