২৮ এপ্রিল ২০২৪, রবিবার, ১০:৪১:২৭ অপরাহ্ন
সারা দেশে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৬৩৩ একর জমি বেহাত
  • আপডেট করা হয়েছে : ৩০-০৯-২০২৩
সারা দেশে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৬৩৩ একর জমি বেহাত

রাজধানীর মগবাজারের মধুবাগের শের-ই-বাংলা স্কুল অ্যান্ড কলেজের জমির পরিমাণ নথিতে ২ একর। কিন্তু বাস্তবে আছে আধা একরের কিছু বেশি। অর্থাৎ জমির প্রায় তিন-চতুর্থাংশই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির দখলে নেই। এটিসহ সারা দেশের ১ হাজার ৮৯১টি বেসরকারি স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৬৩৩ একরের বেশি জমি বেহাত হয়ে গেছে।


এই তথ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ)। জমি বেহাত ছাড়াও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাল সনদ, অবৈধ নিয়োগ, তথ্য গোপন করে বেতন উত্তোলন, প্রাপ্যতার অতিরিক্ত উত্তোলনসহ বিভিন্ন কারণে সাড়ে ৪৩ কোটি টাকার বেশি অনিয়মের তথ্যও পেয়েছে অধিদপ্তর। ২০২১-২২ অর্থবছরে করা নিরীক্ষায় এসব তথ্য উঠে এসেছে ডিআইএর গবেষণা প্রতিবেদন ২০২৩-এ।


অনিয়ম করা অর্থ আদায় করে সরকারি কোষাগারে ফেরত দেওয়ার এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। গত ৩০ জুন প্রতিবেদনটি শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির সভাপতিত্বে এক সভায় উপস্থাপন করা হয়।


ডিআইএর পরিচালক অধ্যাপক অলিউল্লাহ্ মো. আজমতগীর আজকের পত্রিকাকে বলেন, প্রতিটি নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বেহাত হওয়া জমি ও অন্যান্য অনিয়ম গুরুত্বসহ তুলে ধরে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করা হয়েছে।


ডিআইএ শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন এবং আর্থিক স্বচ্ছতা আনতে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও নিরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেয়। প্রতিবেদনের সুপারিশের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।


জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (নিরীক্ষা ও আইন) মূকেশ চন্দ্র বিশ্বাস আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ডিআইএ’র তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশের আলোকে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেহাত হওয়া জমি উদ্ধারে আমাদের অবস্থান অত্যন্ত কঠোর।’


দেশে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে প্রায় ৩৬ হাজার। ডিআইএ প্রতিবছর গড়ে ২ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিরীক্ষা ও তদন্ত করে। এ জন্য পুরো দেশকে আগের চারটি বিভাগে ভাগ করে কার্যক্রম চালায়। বিভাগ চারটি হলো: 


ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহী। 


বেহাত ৬৩৩ একর জমি 

গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ১ হাজার ৮৯১টি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মোট ৬৩৩ দশমিক ৩৯৩৬ একর জমি বেহাত হয়েছে। বেহাত জমির মধ্যে ১ হাজার ৩৬৮টি সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (স্কুল/কলেজ/স্কুল অ্যান্ড কলেজ) ৪২৮ দশমিক ৪৬০৫ একর এবং ৪৮২টি মাদ্রাসা এবং ৪১টি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ২০৪ দশমিক ৯৩৩১ একর জমি রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগের ৪৮০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ২৩৫ দশমিক ৩৬৩৪ একর, রাজশাহী বিভাগের ৬২৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১৫৮ দশমিক ৮২৪৫ একর, চট্টগ্রাম বিভাগের ৪৩১টি প্রতিষ্ঠানের ১৪৩ দশমিক ৪৫১৬ একর এবং খুলনা বিভাগের ৩৫৫ প্রতিষ্ঠানের ৯৫ দশমিক ৭৫৪০৮ একর জমি বেহাত হয়েছে।


ডিআইএর প্রতিবেদন অনুযায়ী, মধুবাগের শের-ই-বাংলা স্কুল অ্যান্ড কলেজের ১ দশমিক ৪৬ একর জমি বেহাত হয়েছে। ২০ সেপ্টেম্বর ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখা যায়, এর এক দিকে সড়ক, বাকি তিন দিকেই বহুতল আবাসিক ভবন। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক আবদুস সাত্তার বলেন, ‘কাগজে ২ একর জমি আছে, বাস্তবে নেই। আমরা ৫৩ দশমিক ২ শতাংশ জমির খাজনা দিচ্ছি। বাকি জমি কোথায় এ নিয়ে মন্তব্য করতে চাই না।’


নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষকের অভিযোগ, দাতা সদস্যদের কেউ কেউ স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য দেওয়া জমির বেশির ভাগ অংশ পরে নিজেদের প্রয়োজনে দখল করেছেন।


ডিআইএর তথ্যমতে, নারায়ণগঞ্জের জয়গোবিন্দ উচ্চবিদ্যালয়ের শূন্য দশমিক ৮০ একর জমি বেহাত হয়েছে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল হালিম সরকার আজকের পত্রিকাকে বলেন, প্রতিষ্ঠাকালীন জয়গোবিন্দ রায় চৌধুরীর ২০০ শতাংশ জায়গা থেকে স্কুলের নামে খারিজ হয়েছে ৬৭ শতাংশ। বাকিটা কোথায় আছে তাঁর জানা নেই।


তবে একজন শিক্ষক বলেন, সামনের পুকুরের জমিটি বিদ্যালয়ের। আগে পুকুর ছিল না। এখান থেকে মাটি কেটে স্কুলমাঠ ভরাট করায় পুকুর হয়েছে। পরে ধীরে ধীরে পুকুরটি স্কুলের বাইরে থেকে যায়। এখন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) মাছ চাষ করছে, এলাকাবাসী গোসল করে। পুকুরটি কারও দখলে না, আবার স্কুলও পুকুরটি পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারে না।


জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘পুকুরটি আমাদের না সিটি করপোরেশনের, তা জানা নেই। আমরাও ব্যবহার করি, নাসিকও ব্যবহার করে। আমি আসার আগে এই পুকুর ভরাট করতে চেয়েছিল, তখন এলাকাবাসী বাধা দিয়েছে। এর পর থেকে পুকুর সবাই ব্যবহার করছে।’


বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার মথুরাপাড়া বি কে উচ্চবিদ্যালয়ের ৫ দশমিক ৭৫ একরের মধ্যে ৪ দশমিক ৭৩ একর বেহাত বলে উল্লেখ আছে প্রতিবেদনে। তবে বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক তোফায়েল আহমেদ বলেন, বর্তমানে স্কুলের জমির পরিমাণ ২ একর। এর মধ্যে দেড় একরের খাজনা দেওয়া হচ্ছে, বাকি আধা একরও স্কুলের দখলে। বাকি জমি নদীভাঙনে কমেছে।


তদন্ত কার্যক্রমে যুক্ত একাধিক শিক্ষা পরিদর্শকের মতে, অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি এবং প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের জমি বেহাতের ঘটনায় যোগসূত্র বা অবহেলা থাকে। প্রতিবেদনে বেহাত হওয়া জমি প্রতিষ্ঠানের দখলে এনে মন্ত্রণালয়কে জানানোর এবং বেহাত হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করার সুপারিশ করা হয়েছে।


মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ গোলাম ফারুক বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জমি বেহাত কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। বিষয়টি দুঃখজনক। বেহাত হওয়া জমি উদ্ধারে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। 


সাড়ে ৪৩ কোটি টাকার অনিয়ম 

ডিআইএর প্রতিবেদন বলছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অবৈধ নিয়োগ, প্রাপ্যতার অতিরিক্ত টাকা উত্তোলন, প্রাপ্য স্কেলে বেতন না নেওয়া, তথ্য গোপন করে বেতন উত্তোলন এবং জাল সনদ দিয়ে চাকরির মাধ্যমে ৪৩ কোটি ৫৩ লাখ ৭০ হাজার ১৫৬ টাকার অনিয়ম হয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৬৮টি সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ২৯ কোটি ৩২ লাখ ৯৪ হাজার ৮৭৭ টাকার এবং ৫২৩টি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মাদ্রাসায় মোট ১৪ কোটি ২০ লাখ ৭৫ হাজার ২৭৯ টাকার অনিয়ম হয়েছে। এসব অর্থ চালানের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে ফেরত দেওয়ার এবং অভিযুক্ত শিক্ষক/কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। 


জাল সনদধারী ৮৬ জন 

প্রতিবেদন অনুযায়ী, এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ৮৬ জন শিক্ষক ও কর্মচারীর শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ জাল পেয়েছে নিরীক্ষা দল। এ জন্য বেতন-ভাতা বাবদ নেওয়া ১৩ কোটি ৮৩ লাখ ৮৫ হাজার ৫৩৫ টাকা এমপিওভুক্ত এই শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছ থেকে আদায়ের সুপারিশ করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারী ৬৮ জন বেতন-ভাতা নিয়েছেন ১০ কোটি ৮৬ লাখ ৯ হাজার ২৩৮ টাকা এবং কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মাদ্রাসার ১৮ জন শিক্ষক-কর্মচারী নিয়েছেন ২ কোটি ৯৭ লাখ ৭৬ হাজার ২৯৭ টাকা। 

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জমি বেহাতের ঘটনা উদ্বেগজনক। এর সঙ্গে জড়িত সব পক্ষকে এবং নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষকেও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।


(প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি সাবিত আল হাসান, বগুড়া প্রতিনিধি গনেশ দাস ও ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি সাদ্দাম হোসেন)


শেয়ার করুন