২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ০৯:৩৭:১৫ অপরাহ্ন
আজও যদি তিনি থাকতেন...
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৫-০৯-২০২৩
আজও যদি তিনি থাকতেন...

২৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির জন্য একটি স্মরণীয় দিন। ১৯৭৪ সালের এই দিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রথম বাংলায় ভাষণ দিয়ে আমাদের মাতৃভাষাকে অনন্য এক উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিলেন। বিশ্বের সর্বোচ্চ দরবারে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রথম মাতৃভাষায় ভাষণ দেওয়ার মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণিত হয়েছে, বাঙালি জাতির সব বড় ও মহতী অর্জন তাঁর হাত ধরেই হয়েছে।


বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ ও কূটনীতিক ফারুক চৌধুরীর লেখা থেকে জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর প্রথম ভাষণ সম্পর্কে যেসব তথ্য পাওয়া যায়, তার ভিত্তিতেই এই নিবন্ধ লেখা হয়েছে। উল্লেখ্য, তোফায়েল আহমেদ তখন ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক উপদেষ্টা আর ফারুক চৌধুরী ছিলেন লন্ডনে বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার।


বঙ্গবন্ধুর বাংলা বক্তৃতার ইংরেজি ভাষান্তর করার গুরুদায়িত্বটি অর্পিত হয়েছিল ফারুক চৌধুরীর ওপর। তিনি তখন ছুটিতে দেশে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধু ফারুক চৌধুরীকে ডেকে বলেছিলেন, ‘তোমার লন্ডনে যাওয়া চলবে না। তুমি আমার সঙ্গে নিউইয়র্কে যাবে এবং জাতিসংঘে আমি বাংলায় যে বক্তৃতাটি করব, তাৎক্ষণিকভাবে তুমি সেই বক্তৃতার ইংরেজি ভাষান্তর করবে।’


এ কথা শুনে ফারুক চৌধুরী একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। তখন পরিস্থিতি সহজ করতে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘রিহার্সাল দাও। বক্তৃতা ভাষান্তরের সময় ভাববে, যেন তুমিই প্রধানমন্ত্রী। তবে পরে কিন্তু তা ভুলে যেও।’


ফারুক চৌধুরীর লেখা ‘স্মরণে বঙ্গবন্ধু’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, সফরের আগে পররাষ্ট্রসচিব একদিন বলেন, জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রণয়নে সে সময়ের তথ্য প্রতিমন্ত্রী তাহেরউদ্দিন ঠাকুর খুবই আগ্রহ দেখান। ঠাকুর এর আগে ইত্তেফাকের রিপোর্টার ছিলেন। তিনি মনে করতেন, বাংলা ভাষায় তাঁর খুব দখল রয়েছে। জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধু বাংলাতেই ভাষণ দেবেন, এটি জানার পর তাহের ঠাকুর বাংলায় ভাষণের একটি খসড়া প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশ করেন। পরে জানা যায়, তাহের ঠাকুরের ওই ভাষণ বঙ্গবন্ধুর পছন্দ হয়নি।


সে সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব ছিলেন ফখরুদ্দীন আহমদ। জাতিসংঘে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণটির একটি খসড়া তৈরি করে পররাষ্ট্রসচিব ফখরুদ্দীন আহমদ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেই সময়ের পদস্থ কর্মকর্তা ফারুক চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনায় বসেন।


ভাষণ পাঠ শেষে প্রধানমন্ত্রী তাঁদের বলেন, ‘ভালোই তো তোমাদের ফরেন সার্ভিসের বক্তৃতা। কিন্তু তোমরা যে আসল কথাই লেখনি। দেশে বন্যা হয়ে গেল, দুর্ভিক্ষ হতে যাচ্ছে, সেই কথাটিই তো আমি জাতিসংঘে বলবার চাই। বাংলাদেশের সমস্যার কথা বিশ্ববাসী আমার মুখ থেকেই শুনুক। তোমাদের সংশয় কেন?’


সাঁটলিপিকার রোজারিওকে ডেকে আনা হলো। অদূরে সোফা দেখিয়ে ফারুক চৌধুরীকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ওখানে বসে আসন্ন খাদ্যাভাব সম্বন্ধে একটি লাইন তুমি আমার বক্তৃতায় জুড়ে দাও।’


এটা এখন জানা তথ্য যে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে জাতিসংঘের ১৩৬তম সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি লাভ করে বাংলাদেশ। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর ৯ মাসের বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ শেষে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বিজয় নিশ্চিত হলেও জাতিসংঘের সদস্যপদ পাওয়ার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে আরও প্রায় তিন বছর। জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি বঙ্গবন্ধুর নিরলস কূটনৈতিক চেষ্টার একটি বড় সাফল্য। এর মাত্র আট দিন পর ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ২৯তম অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বাংলায় যুগান্তকারী ভাষণটি দেন।


জাতিসংঘের সেক্রেটারিয়েট থেকে ইংরেজিতে ভাষণ দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। ওই সময় জাতিসংঘে যে ছয়টি ভাষায় বক্তৃতা দেওয়ার রেওয়াজ ছিল, তার মধ্যে বাংলা ভাষা ছিল না। বঙ্গবন্ধু আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি বাংলায় ভাষণ দেবেন। আন্তর্জাতিক ফোরামে প্রথম বাংলা ভাষায় বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শুনে উপস্থিত সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানগণ মুগ্ধ হন।


এর আগে পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে চীন সফরে গিয়েও তিনি বাংলায় ভাষণ দিয়েছেন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তিনি লিখেছেন, ‘আমি বাংলায় বক্তৃতা করলাম। … কেন বাংলায় বক্তৃতা করব না? … পূর্ববাংলার ছাত্ররা জীবন দিয়েছে মাতৃভাষার জন্য। বাংলা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু লোকের ভাষা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে না জানে এমন শিক্ষিত লোক চীন কেন, দুনিয়ার অন্যান্য দেশেও আমি খুব কম দেখেছি। আমি ইংরেজিতে বক্তৃতা করতে পারি। তবু আমার মাতৃভাষায় বলা কর্তব্য।’


এই কর্তব্যবোধ থেকেই বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘেও মাতৃভাষায় বক্তৃতা দেওয়ার সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন। নিউইয়র্ক সময় বিকেল ৪টায় বঙ্গবন্ধুকে বক্তৃতার জন্য আহ্বান জানানো হয়। এ সময় সাধারণ সভার সভাপতি আলজেরিয়ার তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রপতি আব্দুল আজিজ ব্যুতফলিকা নিজ আসন থেকে উঠে এসে তাঁকে মঞ্চে তুলে নেন। গলাবন্ধ কোট, কালো ফ্রেমের চশমা আর ব্যাকব্রাশ করা চুলের উন্নত শির বঙ্গবন্ধু মঞ্চে দাঁড়ান। দীর্ঘদেহী, সুদর্শন আর আভিজাত্যপূর্ণ সৌম্য ব্যক্তিত্ব শেখ মুজিবকে দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারেননি নানা দেশের প্রতিনিধিরা।


বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ও মুক্তিসংগ্রামে সমর্থনকারী দেশ ও জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ছিল শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মিলিত সংগ্রাম।’


শেয়ার করুন