২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ১০:৪১:২৩ অপরাহ্ন
রপ্তানির আড়ালে ৬৮২ কোটি টাকা পাচার
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৫-০৯-২০২৩
রপ্তানির আড়ালে ৬৮২ কোটি টাকা পাচার

তৈরি পোশাক রপ্তানির আড়ালে গত ৫ বছরে ১৪টি প্রতিষ্ঠান অন্তত ৬৮২ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। এসব প্রতিষ্ঠান সিএন্ডএফ এজেন্টের সহায়তায় জাল কাগজপত্র বানিয়ে পণ্য বোঝাই শত শত কনটেইনার মধ্যপ্রাচ্যসহ ২৮টি দেশের অপ্রচলিত বাজারে রপ্তানি করে। প্রতিষ্ঠানগুলো বিল অব এক্সপোর্ট জালিয়াতি এবং অন্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের ই-এক্সপি ব্যবহার করে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে এসব পণ্য রপ্তানি করে।


কিন্তু পণ্যগুলোর বিপরীতে প্রযোজ্য বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসেনি। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এমনকি কাস্টমস কর্তৃপক্ষও কোনো প্রশ্ন তোলেনি, কারও বিরুদ্ধে তদন্তও হয়নি। তবে সম্প্রতি শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করে। সংস্থাটির যুগ্ম পরিচালক মো. শামসুল আরেফিন খান সোমবার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।



এর আগে দৈনিক যুগান্তরে রপ্তানির আড়ালে অর্থ পাচার নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর নড়েচড়ে বসে। এরপর তারা ওই রিপোর্টসংক্রান্ত তথ্য-উপাত্তের বিষয়ে যুগান্তর প্রতিনিধির সঙ্গেও কথা বলে। 


জানা যায়, এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর তদন্ত শুরু করে। সেই সূত্র ধরে কয়েকটি কাগুজেসহ ১৪টি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান  অভিনব কৌশলে জালিয়াতি করে দেশ থেকে অর্থ সরিয়েছে বলে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে।   


শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা অবশ্য পোশাক রপ্তানির নামে অর্থ পাচারের সঙ্গে ১০টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ৩০০ কোটি টাকা পাচারের সম্পৃক্ততার কথা জানাচ্ছে। কিন্তু যুগান্তরের কাছে যে তথ্য রয়েছে, তাতে প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১৪। পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ ৬৮২ কোটি টাকা। শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর  গত মার্চে তাদের প্রতিবেদনে বাকি চার প্রতিষ্ঠানের নাম এবং তাদের পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ উল্লেখ করে।


সব মিলে ১৪টি প্রতিষ্ঠান নমুনা ঘোষণায় পণ্য রপ্তানি করে সমুদয় অর্থই বিদেশে পাচার করে দিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান সরকারি সংস্থাগুলোর নজর এড়াতে বিল অব এক্সপোর্ট জালিয়াতির মাধ্যমে অন্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের ইএক্সপি (রপ্তানি অনুমতিপত্র) ব্যবহার করে পণ্য রপ্তানি করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো ১২৩৪টি পণ্যচালানে ৯১২১ টন পণ্য বিদেশে পাঠিয়েছে।


পণ্যের মধ্যে রয়েছে টি-শার্ট, টপস, লেডিস ড্রেস, ট্রাউজার, বেবি সেট, পোলো শার্ট ইত্যাদি। সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কাতার, সৌদি আরব, নাইজেরিয়ায় এসব পণ্য জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে রপ্তানি করে। 


যেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পণ্য রপ্তানির নামে বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে সেগুলো হচ্ছেÑপ্রজ্ঞা ফ্যাশন লিমিটেড, ফ্যাশন ট্রেড, এমডিএস ফ্যাশন, হংকং ফ্যাশনস লিমিটেড, থ্রি-স্টার ট্রেডিং, ফরচুন ফ্যাশন, অনুপম ফ্যাশন ওয়্যার লিমিটেড, পিক্সি নিট ওয়্যারস লিমিটেড, স্টাইলাইজ বিডি লিমিটেড এবং ইডেন স্টাইল টেক্স। 


সূত্র জানায়, এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কাস্টমস আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর জানায়, আশুলিয়ায় প্রজ্ঞা ফ্যাশন ২০১৯-২০ সালে ৩৯১টি চালানের মাধ্যমে ৩ হাজার ৮০ টন টি-শার্ট, প্যান্ট, ট্যাংক-টপ, পাজামা সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়ায় রপ্তানি করেছে। রপ্তানিকৃত পণ্যের ম্ল্যূ ৯২ কোটি টাকা। গুলশানের ফ্যাশন ট্রেড ২০১৮-২০ সালে ২৪৬টি চালানের মাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ফিলিপাইন, নাইজেরিয়া, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড, সুদান, মালয়েশিয়ায় টি-শার্ট, প্যান্ট, ট্যাংক-টপ, পাজামা রপ্তানি করেছে। এসব পণ্যের রপ্তানিমূল্য ৬৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। একই কায়দায় উত্তরার এমডিএস ফ্যাশন ৪৪ কোটি টাকা, গাজীপুরের হংকং ফ্যাশনস ৪০ কোটি ৬৬ লাখ টাকা, বনানীর থ্রি-স্টার ট্রেডিং ২৬ কোটি টাকা, মিরপুরের ফরচুন ফ্যাশন প্রায় ১৩ কোটি টাকা, কচুক্ষেতের অনুপম ফ্যাশন ওয়্যার ৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা, টঙ্গী গাজীপুরের পিক্সি নিটওয়্যারস ৫ কোটি ৬ লাখ টাকা, শাহবাগের স্টাইলাইজ বিডি ২ কোটি ১৭ লাখ টাকা, খিলক্ষেতের ইডেন স্টাইল টেক্স এক কোটি ৬৪ লাখ টাকার পণ্য রপ্তানি করেছে।  


শুল্ক গোয়েন্দা সূত্র আরও জানায়, অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের বিল অব এক্সপোর্ট পর্যালোচনায় দেখা গেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে টি-শার্ট রপ্তানি করা হয়েছে। এক্ষেত্রে টি-শার্টের অস্বাভাবিক ওজন দেখা গেছে। প্রতি পিস টি-শার্টের ওজন দেখানো হয়েছে ৫০০, ৮০০ গ্রাম বা ক্ষেত্রবিশেষে এক কেজির বেশি। প্রকৃতপক্ষে প্রতি কেজি নিট ফেব্রিক্স দিয়ে কমপক্ষে ৩-৬টি বড় আকারের টি-শার্ট বানানো যায়। শুল্ক গোয়েন্দা প্রতিটি টি-শার্টের গড় ওজন ন্যূনতম ২৫০ গ্রাম ধরে রপ্তানিকৃত টি-শার্টের সংখ্যা হিসাব করেছে। এছাড়া কিছু কিছু পণ্যচালানে রপ্তানি পণ্যের মূল্য খুবই কম ঘোষণা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সমসাময়িক রপ্তানি চালানের সমজাতীয় পণ্যের মূল্য বিবেচনায় নিয়ে সম্ভাব্য অর্থ পাচারের তথ্য নির্ধারণ করেছে। 


সূত্র আরও জানায়, কিছু প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বই পাওয়া যায়নি। শাহবাগে স্টাইলাইজের ঠিকানায় রয়েছে পোশাকের শোরুম। আর কচুক্ষেতে অনুপম ফ্যাশনের ঠিকানায়ও অন্য প্রতিষ্ঠান পাওয়া গেছে। ফলে নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানগুলো আদৌ রপ্তানি করেছে কিনা, তা উদঘাটনে তদন্ত চলছে। কেননা সিএন্ডএফ এজেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলোও দায় স্বীকার করছে না। 


শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর থেকে গঠিত তদন্ত কমিটির একজন সদস্য যুগান্তরকে জানান, পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে যে অনুমতিপত্র (ইএক্সপি) ব্যবহার করা হয়েছিল, সেগুলো ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে। একটি ইএক্সপিতে একাধিক রপ্তানির চালান ব্যবহারের সুযোগ নেই। ফলে এসব ইএক্সপির কার্যকারিতাও নেই। এ কারণে বৈধ পথে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগ নেই।


তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রটি জানায়, পণ্যচালান বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে, কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রা প্রত্যাবাসিত হচ্ছে নাÑএমন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো বিল অব এক্সপোর্ট জালিয়াতি করে অন্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের ইএক্সপি (রপ্তানি অনুমতিপত্র) ব্যবহার করে পণ্য রপ্তানি করেছে। এছাড়া বিল অব এক্সপোর্টের ২৪ নম্বর কলামে নমুনার কোড ২০ ব্যবহার করেছে। এক্ষেত্রে কোনো অর্থ দেশে প্রত্যাবাসিত না হয়ে সমুদয় রপ্তানি মূল্য বাবদ অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে। কাস্টমস গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, ১০ প্রতিষ্ঠানের বিল অব এক্সপোর্টসমূহ পর্যালোচনায় বিল অব এক্সপোর্ট ও ইএক্সপিতে বর্ণিত তথ্যের মধ্যে মিল পাওয়া যায়নি। 

 

এছাড়া বিল অব এক্সপোর্টে উল্লিখিত সাউথইস্ট ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্যমতে, ১০  প্রতিষ্ঠানের কোনোটিই ওই ব্যাংকে লিয়েনকৃত নয়। প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যবসায়িক কার্যক্রমের সঙ্গে  ব্যাংকটি সম্পর্কিত নয় বিধায় ওই ব্যাংকের মাধ্যমে বিল অব এক্সপোর্টে উল্লিখিত সেলস কন্ট্রাক্ট বা ইএক্সপির রপ্তানি মূল্য  প্রত্যাবাসিত হয়নি বা হওয়ার কোনো সুযোগও নেই। কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর ঢাকার যুগ্ম পরিচালক মো. শামসুল আরেফিন খান জানান, ওই ১০টি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যথাযথ কার্যক্রম গ্রহণের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।


এর আগে মার্চ মাসে ৪টি প্রতিষ্ঠানে ৩৮২ কোটি টাকা পাচারের তথ্য জানায় শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশে পণ্য রপ্তানি করলেও দেশে টাকা আনেনি। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছেÑঢাকার দক্ষিণখানের সাবিহা সাইকি ফ্যাশন, ঢাকার কাকরাইলের এশিয়া ট্রেডিং করপোরেশন, ঢাকার দক্ষিণখানের ইমু ট্রেডিং করপোরেশন এবং ঢাকার উত্তরার ইলহাম ট্রেডিং করপোরেশন। 


সাবিহা সাইকি ফ্যাশন ৮৬টি পণ্য চালানের বিপরীতে ৯৯৭ টন পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে প্রায় ১৮ কোটি টাকা, এশিয়া ট্রেডিং করপোরেশন এক হাজার ৩৮২টি চালানে ১৪ হাজার ৮৫ টন পণ্য রপ্তানি করে ২৮২ কোটি টাকা, ইমু ট্রেডিং করপোরেশন ২৭৩টি চালানে দুই হাজার ৫২৩ টন পণ্যের বিপরীতে ৬২ কোটি টাকা এবং ইলহাম নামক প্রতিষ্ঠান ৩৯টি চালান রপ্তানি করে ১৭ কোটি টাকা পাচার করেছে। এই অপকর্মের সহযোগী হিসাবে কাজ করেছে চট্টগ্রামের দক্ষিণ হালিশহর সিমেন্ট ক্রসিং এলাকার লিমেক্স শিপার্স লিমিটেড নামের সিএন্ডএফ প্রতিষ্ঠান। অভিযুক্ত চারটি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানেরই সিএন্ডএফ এজেন্ট ছিল লিমেক্স শিপার্স লিমিটেড। 


এ বিষয়ে নিটপণ্য প্রস্তুতকারকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম যুগান্তরকে বলেন, অর্থ পাচার কোনোভাবেই কাম্য নয়। এ ঘটনায় জড়িতদের কঠোর বিচার হওয়া উচিত। বিকেএমইএ’র কোনো সদস্য যুক্ত থাকলে সংগঠনের সংঘবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

 


শেয়ার করুন