০১ মে ২০২৪, বুধবার, ০৮:০০:১৪ অপরাহ্ন
বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচন নিয়ে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রে টানাটানি
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৯-০৮-২০২৩
বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচন নিয়ে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রে টানাটানি

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে অবস্থান নিয়েছে ভারত। নিজেদের কৌশলগত বৈশ্বিক মিত্র যুক্তরাষ্ট্রকে দেওয়া এক কূটনৈতিক বার্তায় এই অবস্থান স্পষ্ট করেছে দেশটি। সেই বার্তায় তারা বলেছে, শেখ হাসিনার সরকার দুর্বল হলে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র কারও জন্যই তা ভালো হবে না। দিল্লি থেকে গতকাল শুক্রবার করা এক প্রতিবেদনে এই কূটনৈতিক বার্তাটির কথা প্রকাশ করেছে জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলে।


নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করার জন্য ‘সহায়তা’ হিসেবে বাংলাদেশের বিষয়ে নতুন ভিসা নীতি আরোপ করার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতায় আসার জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর পরোক্ষ চাপ দিয়ে চলেছে। এমন সময় ভারত নিজের নিরাপত্তাঝুঁকির দিকটি সামনে এনে দেশটিকে ওই বার্তা দিয়েছে বলে মনে করছেন দেশটির এক বিশ্লেষক।


ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাবেক লে. জেনারেল উৎপল ভট্টাচার্য ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক মসৃণ থাকে। ভূরাজনৈতিক কারণেও বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকার দেখতে চায় ভারত। ভারত মনে করে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকলে দুই দেশের সীমান্ত আপাতদৃষ্টে সুরক্ষিত থাকে।


নির্বাচন সামনে রেখে ঢাকা ও ওয়াশিংটনে মার্কিনদের তোড়জোড়ে শেখ হাসিনার অবস্থান দুর্বল হওয়ার ঝুঁকি দেখছে ভারত। 

বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকার দুর্বল হয়ে পড়লে তা ভূরাজনৈতিক দিক থেকে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র কারও জন্য ভালো হবে না, দিল্লির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কূটনৈতিক বার্তায় মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগকে এমনটাই জানিয়েছে। ভারত বলেছে, শেখ হাসিনার সরকার দুর্বল হলে উগ্র মৌলবাদী দল জামায়াতে ইসলামীর প্রভাব বাড়বে।


পাকিস্তানের সঙ্গে এই দলের নিবিড় যোগাযোগ আছে। জামায়াতের প্রভাব বাড়লে বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘ সীমান্তে ভারতের নিরাপত্তা সমস্যা বাড়বে।


যুক্তরাষ্ট্রের নাম না নিয়ে শেখ হাসিনা গত বুধবার ঢাকায় বলেছেন, তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এর আগে গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র সফর থেকে ফিরেও তিনি একই আশঙ্কা প্রকাশ করেন।


আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল দিল্লি ঘুরে যাওয়ার পর ভারত নির্বাচন প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। ডয়চে ভেলে দিল্লির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে এসব কথা বলেছে।


আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ৬ আগস্ট থেকে তিন দিন দিল্লি ছিল।


ডয়চে ভেলে বলেছে, আগামী ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে উন্নত দেশগুলোর প্ল্যাটফর্ম জি২০-এর সম্মেলন হবে। সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আসবেন। এ সম্মেলনের পাশাপাশি বাইডেনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠক হবে। এ বৈঠককে সামনে রেখে বাংলাদেশের নির্বাচন প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রকে বার্তা দিল ভারত। ভারত বলেছে, তারাও বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু ভোট চায়, তবে তা শেখ হাসিনার অবস্থান দুর্বল করে নয়।


তবে ভারতের তরফ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে এমন বার্তা দেওয়ার বিষয়টি নতুন নয় বলে উল্লেখ করেন পররাষ্ট্র বিষয়ে বাংলাদেশের এক বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, মার্কিনরা বার্তাগুলো কীভাবে নেয়, তার ওপর বার্তার ফলাফল নির্ভর করে।


বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট প্রেসিডেন্ট হুমায়ুন কবির বলেন, গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য ভিসা নীতি ঘোষণার এক মাসের মধ্যে নরেন্দ্র মোদি ওয়াশিংটন সফর করেন। তাঁর সফরের কয়েক দিন আগে দিল্লির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে উদ্ধৃত করে ভারতের গণমাধ্যম খবর প্রকাশ করে, মোদি বাংলাদেশের নির্বাচনের বিষয়টি বাইডেনের কাছে তুলবেন। তখন এ বিষয়ে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের মুখপাত্র জানান, যুক্তরাষ্ট্র তার নিজের নীতিতে চলে।


এবার বাইডেনের দিল্লি সফরকে সামনে রেখে ভারত একই কৌশল প্রয়োগ করছে বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক এই রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির।


ভিসা নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র গত ২৪ মে প্রকাশ করলেও দেশটি বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বেশ আগে থেকেই নিজের অবস্থান স্পষ্ট করতে শুরু করেছে বলে মনে করছেন তিনি।


২০২১ সালের ডিসেম্বরে র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের চার মাসের মধ্যে গত বছরের ২২ এপ্রিল মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর বাংলাদেশবিষয়ক এক সমন্বিত কৌশলপত্র প্রকাশ করে।


এই কৌশলপত্র অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, বাংলাদেশে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক না হলে, গণতান্ত্রিক পরিবেশ সংকুচিত হতে থাকলে এবং নাগরিক স্বাধীনতা নিশ্চিত না হলে এখানে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাড়বে। অর্থনৈতিক অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হবে। এর পরিণতিতে আঞ্চলিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সক্ষমতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এসব কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও তার সমমনা অংশীদারদের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি আছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।


কৌশলপত্রে ২০১৮ সালের নির্বাচনকে ত্রুটিপূর্ণ উল্লেখ করে বলা হয়, এর পর থেকেই বাংলাদেশে নাগরিক স্বাধীনতা, আইনের শাসন ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে সংকুচিত করা হয়েছে।


যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, গণতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের মধ্যে কোনটির বিকাশ বাংলাদেশে ভবিষ্যতে ঘটবে, তা নির্ধারণের জন্য ২০২৩ সালের নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।


সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, যুক্তরাষ্ট্র কোনো বড় পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। যদি সত্যিই বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচন করা সম্ভব হয়, এরপর তারা এখানে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায় নজর দেবে।


তারপরও যুক্তরাষ্ট্র বা ভারত, যে যা-ই বলুক, কূটনৈতিক এই বিশেষজ্ঞ মনে করেন, দেশে একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ভোটের মাধ্যমে নিজেদের পছন্দের প্রতিনিধি বেছে নিতে জনগণের অধিকার সমুন্নত থাকা দরকার।


শেয়ার করুন