১৪ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ০১:০৫:১৬ পূর্বাহ্ন
দেশের চা শিল্পে নবদিগন্ত
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৩-০৮-২০২৩
দেশের চা শিল্পে নবদিগন্ত

দেশে চা শিল্পের বয়স প্রায় ২০০ বছর পুরোনো। এ শিল্পে অনেকটাই এগিয়েছে দেশ। মোট জিডিপিতে যার অবদান প্রায় শূন্য দশমিক ৮১ শতাংশ। ভৌগোলিক কারণে পাহাড়ি এলাকা চা চাষের জন্য বেশি উপযোগী। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে সিলেট বিভাগ। মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট ছাড়াও দক্ষিণে চট্টগ্রামের পাশাপাশি উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের সমতলেও চা চাষে উল্লেখযোগ্য সফলতা পাওয়া যাচ্ছে। বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ চা উৎপাদনে বিশ্বে নবম স্থানে রয়েছে। যদিও চাহিদার তুলনায় এই উৎপাদন অনেক কম। এ জন্য প্রয়োজন নতুন প্রযুক্তি ও জাত উদ্ভাবন এবং উন্নত উৎপাদন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। বিষয়টি মাথায় রেখে খরা মৌসুমের জন্য উৎপাদনক্ষম চায়ের জাত উদ্ভাবনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন চা গবেষক ও সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফসল উদ্ভিদবিজ্ঞান ও চা উৎপাদন প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এফ এম সাইফুল ইসলাম এবং তাঁর দল। এ ক্ষেত্রে সম্প্রতি উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে।


সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অব্যবহৃত দুটি টিলা চাষ উপযোগী করে প্রায় দুই একর জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে চা বাগান। প্রায় তিন বছর ধরে এ চা বাগানে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে গবেষক দল। তারা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বাগান থেকে সেরা মানের চায়ের চারা সংগ্রহ করেছেন। সেচের পরিমাণ কমিয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশে চা গাছ টিকিয়ে রাখা যায় কিনা, সে গবেষণা চালিয়েছেন তারা। এ বাগানে ৯ প্রজাতির ভারতীয় টোকলাই জাতের চা গাছ রয়েছে। এ ছাড়াও বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই) উদ্ভাবিত বিটি ১ থেকে বিটি ২১ পর্যন্ত জাত রয়েছে। এর সঙ্গে একটি বাইক্লোনাল জাত ও চারটি দেশি বাগানের ক্লোন রয়েছে। সব মিলিয়ে বাগানটিতে ৩৫ প্রজাতির চা গাছ রয়েছে। লাতিন স্কয়ার ডিজাইনের এ গবেষণা মাঠ থেকে প্রতিদিন ২৪টি প্যারামিটারে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে বলে জানান গবেষকরা।


 


ড. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘সাধারণত নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ছয় মাস বাংলাদেশে চা পাতা তোলা সম্ভব হয়। এই সময়ে চা পাতা তোলা সম্ভব হলে দেশের চা শিল্পে নবদিগন্তের সূচনা হবে। এতে সফল হলে বাংলাদেশে চা উৎপাদন কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। লাভবান হবে দেশ।’ এ ছাড়া মানের দিক দিয়ে তিনি বিটিআরআই উদ্ভাবিত বিটি ২-কে এগিয়ে রেখেছেন। তাঁর মতে, দেশে উদ্ভাবিত বিটি ২ জাতটির পপুলেশন ডেনসিটি কিছুটা বাড়িয়ে দিলেই মোট উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানো সম্ভব। দেশে বাণিজ্যিকভাবে চীনের ক্যামেলিয়া সাইনেনসিস ও আসামের ক্যামেলিয়া আসামিকা– এ দুই ধরনের চা চাষ হয়। এ ছাড়াও পাতা বড় চিন্তা করে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভারতের আসামিকা জাত চাষাবাদে জনপ্রিয়তা থাকলেও মানের দিক থেকে বাংলাদেশি জাতগুলোকে সেরা বলছেন এ গবেষক। পাশাপাশি দেশে চা উৎপাদন বাড়ানোর জন্য প্রায় শত বছরের পুরোনো চা গাছ প্রতিস্থাপন করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।


চা শিল্পের উৎপাদন নিয়ে গবেষক ড. সাইফুল ইসলাম কিছুটা আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা ৩০টিরও বেশি চা বাগান পরিদর্শন করেছি, যেখানে চা উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনায় চা বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন এমন লোকবল পাইনি। বাগানগুলোতে দক্ষ ও উপযুক্ত জনশক্তি নিয়োগ হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে চায়ের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, চা গাছের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ ও মান নিয়ন্ত্রণের জন্য অবশ্যই কৃষি গ্র্যাজুয়েট প্রয়োজন। সঠিক জায়গায় সঠিক মানুষ না থাকলে একসময় সম্ভাবনাময় শিল্পটি মুখ থুবড়ে পড়তে পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘দেশের প্রতিটি চা বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপক পদে উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে কৃষিবিদ নিয়োগ দেওয়া গেলে সমস্যার অনেকটা সমাধান হবে। এতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কৃষি গ্র‍্যাজুয়েটের কর্মসংস্থান নিশ্চিতের পাশাপাশি চা উৎপাদন সন্তোষজনক হারে বাড়ানো সম্ভব।’


ড. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের গবেষণায় টি মাইট (পাতার রস খেয়ে ফেলা ক্ষুদ্র পোকা) ও অন্যান্য ক্ষতিকর পোকা চা পাতার কী ধরনের ক্ষতি করছে তা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া টি মাইট ও অন্যান্য পতঙ্গসহিষ্ণু চায়ের জাত উদ্ভাবনেরও চেষ্টা চলমান।’


প্রধান গবেষক হিসেবে অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম ছাড়াও এ গবেষণায় যুক্ত কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল মালেক, তিনজন পিএচডি শিক্ষার্থী– রশীদুল হাসান, সবুর খান, সাইমুন ইসলাম অনিকসহ বিভাগ দুটির কয়েকজন স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী।


সহযোগী গবেষক অধ্যাপক ড. আব্দুল মালেক বলেন, ‘২০১৮ সালে আমরা কাজ শুরু করি। বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক সাইফুল ইসলামের সঙ্গে যৌথভাবে চায়ের জার্মপ্লাজম গড়ে তুলি। শুধু বর্ষা মৌসুমে চা ভালো হয়– এ ধারণা থেকে বেরিয়ে সারা বছর চা সংগ্রহ করা যাবে এমন খরাসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনের গবেষণা চলমান। পাশাপাশি চায়ের গুণগত মান বাড়ানোর জন্য গবেষণা করছি। এ ক্ষেত্রে ভেষজ গুণসম্পন্ন তুলসীপাতা ও লেমন গ্রাসের নির্যাস চায়ের সঙ্গে মিশিয়ে গুণগত মান বাড়িয়ে কীভাবে তা বাজারজাত করা যায়, সে গবেষণাও চলছে। আশা করছি কিছু দিনের মধ্যেই গবেষণার চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ করতে পারব। এ পর্যন্ত কাজের যতটুকু অগ্রগতি হয়েছে, তা ভালো কিছুই নির্দেশ করছে।’


ড. আব্দুল মালেক জানিয়েছেন, খরাসহিষ্ণু ১০টি জাত প্রাথমিক বাছাই করা হয়েছে, যেগুলো থেকে দুটি বা তিনটি খরাসহিষ্ণু ভালো জাত পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। খুব দ্রুত মাঠ পর্যায়ে জাতগুলো ট্রায়াল দেওয়া হবে। খরাসহিষ্ণু জাত হিসেবে এ গবেষক একটি চীনা ধরনকে এগিয়ে রেখেছেন। তার দেওয়া তথ্য অনুসারে, ওই জাতটির ব্রাঞ্চিং বেশি। ১০ মাস বয়সের গাছ থেকে গড়ে ২২টি শাখা পেয়েছেন গবেষকরা, যা অন্যান্য চা গাছের তুলনায় ২০ গুণ বেশি। এর উত্তোলনযোগ্য পাতার পরিমাণ বেশি ও লিকারের গুণগতমান ভালো। প্রায় ছয় মাসের মধ্যে নতুন জাত নির্বাচন সম্ভব হবে, যা বিটিআরআই উদ্ভাবিত খরাসহিষ্ণু বিটি ১৮, বিটি ২৩-এর চেয়ে বেশি ফলন দেবে বলে প্রত্যাশা করছেন তিনি। এ ছাড়াও খরাসহিষ্ণু জাতটি মাঠ পর্যায়ে পৌঁছানো গেলে চায়ের মোট উৎপাদন ১০-১৫ শতাংশ বাড়ানো সম্ভব বলে জানিয়েছেন তিনি।


সাধারণত গড়ে একজন মানুষ প্রতিদিন ৩-৪ কাপ চা পান করেন। প্রতি কাপের জন্য একটি করে টি ব্যাগ লাগলে প্রতিদিন যে পরিমাণ চা প্রয়োজন, তার সম্পূর্ণটা আসলে দেশে উৎপাদন হচ্ছে না। এ ছাড়া চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালে প্রায় ৯ কোটি ৬০ লাখ, ২০২০ সালে প্রায় ৮ কোটি ৬৩ লাখ, ২০২১ সালে ৯ কোটি ৬৫ লাখ, ২০২২ সালে প্রায় ৯ কোটি ৩৮ লাখ এবং জুন, ২০২৩ পর্যন্ত প্রায় ২ কোটি ৬৪ লাখ কেজি চা উৎপাদন হয়েছে। তবে চা উৎপাদন চাহিদার তুলনায় অনেক কম। চা বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ২০২৫ সালের মধ্যে দেশে ১৪০ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদনের পরিকল্পনা করেছে সরকার, যার মধ্যে ১৩০ মিলিয়ন কেজি চা দিয়ে দেশের চাহিদা পূরণ করে বাকি ১০ মিলিয়ন কেজি চা বিদেশে রপ্তানির পরিকল্পনা রয়েছে।


অন্যদিকে গত দুই দশকে চা ব্যবসায় যুক্ত হয়েছে ১৮টি শিল্পগোষ্ঠী। যেখানে প্রায় ৮০-৯০ লাখ লোক চা উৎপাদন, বিপণন ও রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত। সে ক্ষেত্রে ড. সাইফুল ইসলাম ও তাঁর সহযোগী গবেষকদের গবেষণা সফল হলে খরা মৌসুমে চা উৎপাদন নিশ্চিতের পাশাপাশি দেশীয় ঘাটতি অনেকটা পূরণ করা সম্ভব হবে। এতে পূরণ হবে চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা; কমবে বাণিজ্য ঘাটতি এবং জিডিপিতে বাড়বে চা শিল্পের অবদান।


খরাসহিষ্ণু জাতের উদ্ভাবন


১০টি জাত প্রাথমিকভাবে বাছাই করা হয়েছে। এর মধ্যে দু-তিনটি খরাসহিষ্ণু জাত পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।


খুব দ্রুত মাঠ পর্যায়ে ট্রায়ালে নেওয়া হবে।


খরাসহিষ্ণু জাত হিসেবে এগিয়ে রয়েছে একটি চীনা ধরন।


১০ মাস বয়সের গাছ থেকে গড়ে ২২টি শাখা পেয়েছেন গবেষকরা, যা অন্যান্য চা গাছের তুলনায় ২০ গুণ বেশি।


বিটিআরআই উদ্ভাবিত খরাসহিষ্ণু বিটি ১৮ বিটি ২৩-এর চেয়ে বেশি ফলন দেবে।


লিকারের গুণগতমান ভালো।


মাঠ পর্যায়ে পৌঁছানো গেলে চা উৎপাদন প্রায় ১০-১৫ শতাংশ বাড়ানো সম্ভব।


শেয়ার করুন