২৯ এপ্রিল ২০২৪, সোমবার, ০৭:৩৩:৩০ পূর্বাহ্ন
পাকিস্তানি প্রতিষ্ঠানের কাছেও যাচ্ছে এনআইডির তথ্য!
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৬-০৮-২০২৩
পাকিস্তানি প্রতিষ্ঠানের কাছেও যাচ্ছে এনআইডির তথ্য!

সরকারি-বেসরকারি ১৭০টি প্রতিষ্ঠানের কাছে জাতীয় তথ্যভান্ডারের তথ্য বিক্রি করেছে নির্বাচন কমিশনের এনআইডি অনুবিভাগ। এই তালিকায় আছে পাকিস্তান, হংকং, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিষ্ঠান। তথ্য ক্রেতাদের মধ্যে দেশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি শিল্প গ্রুপও রয়েছে। দেশের নাগরিকদের ব্যক্তিগত গোপনীয় তথ্য করপোরেট, বিশেষ করে বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার এই প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ বেআইনি ও অসাংবিধানিক বলছেন বিশ্লেষকরা।


সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এনআইডি সার্ভারের মতো স্পর্শকাতর তথ্য বাইরে চলে যাওয়ায় দেশের যে কোনো নাগরিক ভয়াবহ সাইবার অপরাধসহ নানা জটিলতার শিকার হতে পারেন।


নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিয়ম অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশনের সংরক্ষিত জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য-উপাত্ত যাচাই সংক্রান্ত সার্ভিস গ্রহণ করতে হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাকে ইসি সচিব বরাবর আবেদন করতে হয়। এরপর আবেদনের সঙ্গে জমা দেওয়া কাগজপত্র যাচাই করা হয়। প্রয়োজনে তদন্তও করা হয়। ইতিবাচক প্রতিবেদন পাওয়া গেলে কমিশন তা অনুমোদন দেয়। এরপর আবেদনকারী প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত ফি ও ভ্যাট পরিশোধ করলে ইসি তাদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করে। এরপর ইসি অনুমোদিত ভেন্ডর প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এনআইডি সার্ভারের সঙ্গে ভিপিএন স্থাপন এবং এনআইডি ডাটাবেজে প্রবেশের (এক্সেস) জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে মাস্টার ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড দেওয়া হয়। এরপর মাসিক হিট সংখ্যা অনুযায়ী ইসি থেকে পাঠানো বিলের ভিত্তিতে চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা ফি পরিশোধ করে।


ইসির জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগের কাছ থেকে পাওয়া নথিতে দেখা যায়, এনআইডি অনুবিভাগ ইতোমধ্যে ১৭০টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এ ধরনের চুক্তি করেছে। এর মধ্যে ৫৩টি সরকারি প্রতিষ্ঠান, ৬টি মোবাইল ফোন কোম্পানি, ৬৩টি বাণিজ্যিক ব্যাংক, ২৮টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ৫টি বীমা প্রতিষ্ঠান, ৫টি মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল কোম্পানি এবং অন্যান্য ৭টি প্রতিষ্ঠানের নাম রয়েছে। এ তালিকায় পাকিস্তানের ন্যাশনাল ব্যাংক ও হাবিব ব্যাংক, হংকংয়ের এইচএসবিসি ব্যাংক, যুক্তরাজ্যের স্টান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক এবং যুক্তরাষ্ট্রের বীমা প্রতিষ্ঠান মেটলাইফও রয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য ৭টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দেশের স্বনামধন্য দুটি শিল্প গ্রুপের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানও রয়েছে।


এনআইডি বিভাগের চুক্তিপত্র অনুযায়ী, ওই ১৭০টি প্রতিষ্ঠান এনআইডি সার্ভারের প্রবেশাধিকার (এক্সেস) পাবে। সেজন্য এককালীন ৫ লাখ টাকা দিয়ে নিবন্ধন করেছে প্রতিষ্ঠানগুলো। এরপর একেকটি এনআইডি তথ্য যাচাইয়ের জন্য প্রতিবার সরকারি সংস্থাগুলোর কাছ থেকে এক টাকা এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ৫ টাকা ফি আরোপ করে এনআইডি অনুবিভাগ।


অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তালিকায় থাকা এনআরবিসি ব্যাংক সারা দেশের ৫ শতাধিক সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের বুথে ২০ টাকার বিনিময়ে ছবি, বাবা-মায়ের নাম ঠিকানা, পেশা, মোবাইল নম্বরসহ ১১টি ফিচার বিক্রি করে দিচ্ছে। এ ছাড়া এনআইডি অনুবিভাগের কাছ থেকে তথ্য কেনা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে নাগরিকদের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নানাভাবে বাইরে চলে যাচ্ছে।


সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের একটি ওয়েবসাইট থেকে দেশের বিপুলসংখ্যক নাগরিকের নাম, ফোন নম্বর, ইমেইল এবং জাতীয় পরিচিতি নম্বরসহ বিভিন্ন ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হয়েছে বলে দক্ষিণ আফ্রিকাভিত্তিক আন্তর্জাতিক সাইবার নিরাপত্তাবিষয়ক প্রতিষ্ঠান বিটক্র্যাক সাইবার সিকিউরিটির গবেষক ভিক্টর মারকোপাওলোস দাবি করে, যা নিয়ে দেশ বিদেশে শোরগোল পড়ে যায়। বিষয়টি নিয়ে তদন্তের পর ইতোমধ্যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে সরকার গঠিত কমিটি।


সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, এনআইডি সার্ভারের মতো স্পর্শকাতর তথ্য বাইরে চলে যাওয়ায় ভয়াবহ সাইবার ক্রাইমসহ নানা জটিলতায় পড়তে পারেন যে কোনো নাগরিক।


তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা বলেন, ‘আমাদের ডাটা সুরক্ষা আইনটি এখনো খসড়া পর্যায়ে রয়েছে। এই আইনটি পাস হওয়ার আগে এভাবে দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে তথ্য বিক্রি নিরাপদ নয়। এখন সাবাইবার অডিটের মাধ্যমে দেখতে হবে কারা কারা নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে, তাদের সঙ্গে চুক্তি এখনই স্থগিত করতে হবে।’


অবশ্য এনআইডি অনুবিভাগ দাবি করেছে, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন-২০১০ এর ১৩-এর ২ উপধারায় ‘কমিশনের নিকট সংরক্ষিত তথ্য-উপাত্ত গোপনীয় বলিয়া বিবেচিত হইবে বলা’ হলেও ২০১৩ সালে সংশোধিত আইনের ১৩ এর ৩ উপধারায় বলা হয়, ‘উপধারা ২-এ যাহা কিছুই থাকুক না কেন নির্ধারিত পদ্ধতি ও শর্তে কোন ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান কমিশনের নিকট সংরক্ষিত তথ্য-উপাত্ত পাইবার জন্য আবেদন করিতে পারিবে এবং কমিশন উক্তরূপ চাহিত তথ্য-উপাত্ত ভিন্নরূপ বিবেচিত না হইলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে সরবরাহ করিবে।’ আইনের এই ধারা অনুযায়ী এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করা হয়।


জানতে চাইলে আইনজীবী ব্যারিস্টার অনিক আর হক বলেন, ‘সংবিধানে ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া ২০১৬ সালে এ বিষয়ে একটি রিটে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, এই তথ্য শুধু এনআইডি অনুবিভাগের কাছে থাকতে পারে। এসব তথ্য বিক্রি করা সম্পূর্ণ অবৈধ এবং অসাংবিধানিক।’


তিনি বলেন, ‘জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন ২০১০-এ তো এসব তথ্য বিক্রির সুযোগ ছিল না। সেখানে এসব তথ্যকে গোপনীয় বলে বিবেচনা করা হয়েছে। তাহলে ২০১৩ সালের সংশোধিত আইনে কীভাবে ৩ উপধারা যুক্ত করা হল? এটা তো স্ববিরোধী হয়ে গেল। আবার সংশোধিত আইনে ‘ভিন্নরূপ বিবেচিত না হইলে’ মানে কী বুঝানো হলো? এখানে তো বিধি থাকতে হবে। কারও মুখের কথায় তো এটা নিরূপণ করা যাবে না।’


তিনি আরও বলেন, ‘এভাবে পাইকারিভাবে আমার আপনার তথ্য বিক্রির সুযোগ নেই। এটি অপরাধ। আর এনআরবিসি ব্যাংক যেভাবে এই তথ্য বাইরে বিক্রি করছে, তাতে তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা উচিত।’


সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘দেশের সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনেক দুর্বল। এ ক্ষেত্রে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। ফলে নানা সময় নানা অঘটন ঘটে। বর্তমান সময়ের সঙ্গে তালমিলিয়ে নাগরিকদের তথ্য সুরক্ষিত রাখতে এ ক্ষেত্রে আরও দক্ষ জনবল নিয়োগ দিতে হবে এবং সার্বক্ষণিক মনিটর করতে হবে। এর বিকল্প নেই।’


তবে বারবার চেষ্টা করেও এ বিষয়ে এনআইডি অনুবিভাগের মহাপরিচালক এ কে এম হুমায়ূন কবিরের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

শেয়ার করুন