২৯ এপ্রিল ২০২৪, সোমবার, ০৭:২৯:০৫ অপরাহ্ন
হঠাৎ চাপে বিএনপি, কৌশলে পরিবর্তন
  • আপডেট করা হয়েছে : ৩১-০৭-২০২৩
হঠাৎ চাপে বিএনপি, কৌশলে পরিবর্তন

সরকারের পদত্যাগের একদফা দাবি আদায়ে টানা কর্মসূচিতে রয়েছে বিএনপি। তাদের দাবি, জনসম্পৃক্ত শান্তিপূর্ণ আন্দোলনেই দাবি আদায়ে তারা তৎপর। তবে গত শনিবার ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে অবস্থান কর্মসূচিকে ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে হঠাৎ চাপে পড়ে গেছে দলটি। কর্মসূচি ঘিরে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের মধ্যে গাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নতুন করে একাধিক মামলা দেওয়া হয়েছে। দলটির মূল্যায়ন, এর মধ্য দিয়ে সরকার পুরোনো কৌশলে তাদের চাপে রাখার চেষ্টা করছে।


এদিকে সাময়িক চাপ কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে কৌশলে পরিবর্তন এনেছে বিএনপি। এর অংশ হিসেবে দলটির পক্ষ থেকে একদফা আন্দোলনের কর্মসূচি পুনর্মূল্যায়ন করা হয়েছে। সে অনুযায়ী ঘোষণাও করা হয়েছে নতুন কর্মসূচি। ঢাকার প্রবেশপথে অবস্থান কর্মসূচিতে নিপীড়ন-নির্যাতনের প্রতিবাদে আজ সোমবার ঢাকাসহ দেশের সব মহানগর ও জেলা সদরে জনসমাবেশ করবে দলটি।


এদিন কেন্দ্রীয়ভাবে বিকেল ৩টায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এ জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। ঢাকায় মহাসমাবেশকে ঘিরে সারা দেশ থেকে আসা নেতাকর্মীদের ফের তৃণমূলে ফেরত পাঠানো নতুন এ কর্মসূচির লক্ষ্য বলে বিএনপি সূত্র বলছে। আপাতত কেন্দ্র ও তৃণমূলে ঘুরেফিরে টানা কর্মসূচি পালন করা হবে।


সরকারের অবস্থান দেখে আন্দোলনের কৌশল বদল এবং সে অনুযায়ী কর্মসূচিও নির্ধারণ করা হবে। গত শনিবার বিকেলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে।


গত ১২ জুলাই নয়াপল্টনে সমাবেশ থেকে ১৮ ও ১৯ জুলাই ঢাকাসহ দেশব্যাপী দুদিনের পদযাত্রার কর্মসূচি ঘোষণার মধ্য দিয়ে সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের একদফার আন্দোলনে নামে বিএনপি। এরপর ২২ জুলাই সোহরাওয়ার্দীতে ‘তারুণ্যের সমাবেশ’ থেকে ঢাকায় মহাসমাবেশের ঘোষণা দেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ওই মহাসমাবেশে যোগ দিতে কেন্দ্র থেকে সারা দেশের নেতাকর্মীদের ঢাকায় আসার নির্দেশনা দেওয়া হয়।


দলটির উদ্দেশ্য ছিল, পরবর্তী কর্মসূচিগুলোতে নেতাকর্মীদের ব্যাপক হারে সম্পৃক্ত করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আন্দোলনকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো। সে কারণে মহাসমাবেশের বক্তৃতায় শীর্ষ নেতাদের প্রায় সবাই ‘লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত ঘরে না ফেরার’ জন্য দলের নেতাকর্মীদের আহ্বান জানান। কেউ কেউ সমবেতদের অঙ্গীকারও করান। এর মাধ্যমে সারা দেশ থেকে আসা নেতাকর্মীদের ঢাকায় অবস্থানের পরোক্ষ নির্দেশনা দেওয়া হয়।


বিএনপির পরিকল্পনা ছিল, আগামী ১০ আগস্ট পর্যন্ত টানা কর্মসূচি দেওয়া। আগামী ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের কারণে কয়েক দিনের জন্য আন্দোলন স্থগিত রেখে ধারাবাহিকভাবে ঢাকায় সমাবেশ, বিক্ষোভ, অবস্থান, ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচি দেওয়ার চিন্তা দলটির।


বিএনপির অনেকের মত, কর্মসূচি প্রণয়নে এক ধরনের অসামঞ্জস্যতা দেখা গেছে। কারণ, ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে অবস্থানের মতো বড় কর্মসূচি দেওয়া হলেও স্থায়ী কমিটির অনেকেই এ সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। ব্যাপক চিন্তাভাবনা ও প্রস্তুতি ছাড়া এ ধরনের কর্মসূচি দেওয়াকে তাই ভালোভাবে নেননি অনেকে। তারা মনে করেন, এ ধরনের কর্মসূচিতে যে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি তৈরি হবে—সেটা অনুমেয়। তাছাড়া সংঘর্ষ এড়িয়ে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মাধ্যমে গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানোই বিএনপির উদ্দেশ্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোও দাবি আদায়ে তাদের অহিংস কর্মসূচিতে থাকার পরামর্শ দিয়েছে।


পুলিশের অনুমতি ছাড়াই শনিবার ঢাকার পাঁচটি প্রবেশপথে অবস্থান কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। ফলে অবস্থান কর্মসূচি পালন করতে গেলে বিভিন্ন প্রবেশপথে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ এবং ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। ধোলাইখালে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে পিটিয়ে আহত করে পুলিশ। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে ঘটনাস্থল থেকে আটক করে নিয়ে যায়। এ ছাড়া গাবতলী বাসস্টেশন থেকে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমানকেও ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। পরে অবশ্য তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।


এদিকে বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের সময় মাতুয়াইল, শ্যামলীসহ বিভিন্ন এলাকায় গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। ঘটনার পর রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ৪৬৯ নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ করে অন্তত ১৪টি মামলা করা হয়। এসব মামলায় অন্তত ১৪৯ বিএনপি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।


বিএনপির স্থায়ী কমিটির মূল্যায়ন হচ্ছে, বিএনপি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে থাকলেও সরকার ও সরকারি দল তাদের কর্মসূচিকে ভন্ডুল করতে পুরোনো কৌশল অবলম্বন করেছে। গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগেও বিএনপির আন্দোলনে তারা একই কৌশল নিয়েছিল। তখনো তারা গাড়িতে আগুন দিয়ে তার দায় বিএনপির ওপর চাপানোর চেষ্টা করেছিল।


এর মধ্য দিয়ে তখন বিএনপিকে দেশ-বিদেশে সন্ত্রাসী দল হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এ ছাড়া ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার গায়েবি মামলা দেওয়া হয়েছিল। এবারও ক্ষমতাসীনরা একই কৌশল অবলম্বন করেছে। স্থায়ী কমিটির নেতারা মনে করেন, এবার এসব কৌশল কার্যকর করতে পারবে না সরকার।


বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, বিএনপি সহিংসতায় নয়, শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বিশ্বাসী। সরকার সেই শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি ভন্ডুল করে দিয়ে, বাসে আগুন লাগিয়ে ২০১৪ সালের মতো পুরোনো কৌশলে বিএনপিকে একটি সন্ত্রাসী দল হিসেবে তুলে ধরতে চায়; কিন্তু তাদের সে কৌশল কোনো কাজে আসবে না। কারণ, দেশের জনগণ এবং বিশ্বের গণতন্ত্রকামী দেশ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কাছে তাদের অপকৌশল আগেই উন্মোচিত হয়েছে। তিনি আরও বলেন, সরকার যতই ফাঁদ পাতুক না কেন, চূড়ান্তভাবে তাদের পদত্যাগ করতে হবে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে হবে।


এদিকে অবস্থান কর্মসূচি চলাকালে ধোলাইখাল এলাকা থেকে গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে আহতাবস্থায় ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে গিয়ে আপ্যায়ন করা এবং আহত আমান উল্লাহ আমানকে হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সহানুভূতি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ফল পাঠানোর ঘটনায় তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি হয়। বিএনপির মূল্যায়ন হচ্ছে, এটা সরকারের এক ধরনের অপকৌশল, নাটক।


গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এ ঘটনাকে ‘অত্যন্ত নিম্ন রুচির পরিচায়ক ও তামাশাপূর্ণ নাটক’ হিসেবে আখ্যায়িত করে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেন, সরকারের কাছে এত টাকা নেই যে, গয়েশ্বরকে কিনতে পারে। সরকার গ্রেপ্তার করতে পারে, এমনকি প্রাণও নিতে পারে—এ শক্তি সরকারের রয়েছে; কিন্তু গয়েশ্বরকে কোনোভাবেই কিনতে পারবে না। আমান উল্লাহ আমান বলেন, আহতাবস্থায় হাসপাতালে থাকার সময় ওষুধ দিয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল। এমন সময় কে বা কারা দেখতে এসেছিল এবং ফলের ঝুড়ি দিয়ে গেছে, তা তিনি বুঝতে পারেননি। এটা একটি নাটক। অতীতের গৌরবোজ্জ্বল আন্দোলন এবং একদফার চলমান আন্দোলনে তার ভূমিকার পিঠে ছুরি মারার জন্য এবং নেতাকর্মীদের বিভ্রান্ত করার জন্য এ নাটক সাজানো হয়েছে।


শেয়ার করুন