২৯ এপ্রিল ২০২৪, সোমবার, ০৭:১৮:২৬ পূর্বাহ্ন
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিতরাও নামছেন ভোটে
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৮-১১-২০২৩
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিতরাও নামছেন ভোটে

বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর অংশগ্রহণ বিহীন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটারের অংশগ্রহণ বাড়াতে ‘বিদ্রোহী প্রার্থীদের’ ছাড় দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। এমনকি নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে ডামি প্রার্থী ঠিক করার নির্দেশনাও দিয়েছেন দলীয় সভাপতি। তাঁর এমন সবুজ সংকেতের পর মনোনয়ন বঞ্চিতদের অনেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিতে শুরু করেছেন। গতকাল পর্যন্ত ৫৪ আসনে ৭১ জন মনোনয়ন বঞ্চিত ব্যক্তি স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এ সংখ্যা আরও অনেক বাড়তে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। 


নির্বাচন উৎসব মুখর করতে দলীয় নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়াকে উৎসাহিত করার কৌশল আওয়ামী লীগে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে—এমন আশঙ্কাও করছেন দলের একাংশ। তাদের মতে, ভোটের সময় যত ঘনিয়ে আসবে তত দলীয় কোন্দল মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। এতে করে সহিংসতার ঘটনাও ঘটতে পারে, যা দলের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। 


নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। গত রোববার ২৯৮টি আসনে দলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগ। এই তালিকায় নেই ৭১ জন বর্তমান সংসদ সদস্যের নাম। বাদ পড়াদের অনেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোট করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে বাদ পড়া ৯ জন প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন বলে জানা গেছে। 


ফরিদপুর-১ আসনে মনোনয়ন চেয়েছিলেন কৃষক লীগের সাবেক সহসভাপতি ও সাংবাদিক আরিফুর রহমান দোলন। কিন্তু সেখানে মনোনয়ন পায় দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান। মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন দোলন।  নিজের ফেসবুক পেজে তিনি লিখেন ‘ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে লড়াইয়ের অনুমতি দিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। কৃতজ্ঞতা।’ 


চট্টগ্রাম-১২ আসনের সংসদ সদস্য ও বর্তমান হুইপ সামশুল হক চৌধুরী নানান ঘটনায় চলতি গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছেন বারবার। বিতর্কিত এই এমপি এবার বাদ পড়েছেন। সেখানে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি পটিয়া উপজেলা চেয়ারম্যানের পদ থেকে সম্প্রতি পদত্যাগ করেছেন। তবে মাঠ ছাড়ছেন না সামশুল হক। দলীয় মনোনয়ন না পেলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে লড়ার কথা ভাবছেন তিনি। 


রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনের বিতর্কিত এমপি এনামুল হক বাদ পড়ে স্বতন্ত্র নির্বাচনের কথা ভাবছেন। এ নিয়ে নিজের ফেসবুকে লাইভে এসে বক্তব্যও দিয়েছেন। 


ঢাকা-৫ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন সাবেক সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান মোল্লার ছেলে আওয়ামী লীগ নেতা মশিউর রহমান মোল্লা। তাঁর পক্ষ হয়ে ফেসবুকে এ ঘোষণা দিয়েছেন তাঁর ভাই ও ডেমরা থানা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাহুফুজুর রহমান মোল্লা। 


সুনামগঞ্জ-১ আসনের টানা তিনবারের সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন এবার বাদ পড়েছেন। তিনি স্বতন্ত্র নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন। ‘নেত্রী সবার জন্য এবারের নির্বাচন উন্মুক্ত করেছেন। সে জন্য আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী হব। ৩০ তারিখ ডিসির কাছের মনোনয়ন ফরম জমা দেব। ৭ জানুয়ারি ফলাফল পেয়ে যাবেন।’ 


বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য বিভিন্ন সময় সমালোচিত হয়েছেন কক্সবাজার-১ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য জাফর আলম। মনোনয়ন না পেয়ে এবার নৌকার বিরুদ্ধে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের স্বতন্ত্র ভোট করার জন্য বলেছেন। এ আসন জোটের সঙ্গে ভাগাভাগির একটি বিষয়ও আছে, আমি স্বাধীনভাবে ভোটে দাঁড়াতে চাই।’একইভাবে বাদ পড়ে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন বর্তমান এমপি কুমিল্লা-১ সুবিদ আলী ভূঁইয়া, চট্টগ্রাম-৪ আসনে দিদারুল আলম, জামালপুর-৪ আসনে মুরাদ হাসান, ময়মনসিংহ-৩ আসনে নাজিম উদ্দিন আহমেদ, ফরিদপুর-৪ আসনে মুজিবুর রহমান চৌধুরী। 


সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলা চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত জালাল উদ্দিন তালুকদারের মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস ঝুমা তালুকদার। নৌকা না পেয়ে এবার স্বতন্ত্র নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। 


চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহি রাজশাহী-১ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েও পাননি। মনোনয়ন না পেয়ে সোমবার রাজশাহী-১ আসনে স্বতন্ত্র নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। তিনি বলেন,  ‘আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন করাটা আমারও দায়িত্ব। প্রার্থী যত হবে, কেন্দ্রে ভোটার তত আসবে। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন করতেই আমি প্রার্থী হচ্ছি, যাতে বিশ্ববাসী দেখে। আশা করছি, এলাকার ভোটারেরা আমার সঙ্গে থাকবেন।’ 


মনোনয়ন বঞ্চিতদের গণহারে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা নিয়ে আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান কাজী জাফর উল্লাহ আজকের পত্রিকাকে বলেন, আমরা অঙ্গীকার করেছি নির্বাচন উৎসবমুখর পরিবেশে হবে। প্রার্থী যত বাড়বে, ভোটার উপস্থিতিও বাড়বে। এর মধ্য দিয়ে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচন ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করবে। 


আরেক সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মুহাম্মদ ফারুক খান আজকের পত্রিকাকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী গতকাল (রোববার) বলেছেন নির্বাচনে আরও বেশি করে যাতে ভোটাররা আসে প্রয়োজনে আওয়ামী লীগের একজন প্রার্থী, আর যদি অন্য দলের প্রার্থী না থাকে তাহলে আমাদের ডামি প্রার্থী দেওয়া হয়, যাতে ভোট বেশি হয়। 


আওয়ামী লীগের ডামি প্রার্থী দেওয়ার কৌশলের সমালোচনা করেছেন একাধিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তাদের একজন বলেন, বিষয়টিকে আমরা ইতিবাচক হিসাবে দেখব না। কারণ নির্বাচন এমন প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে মানুষ তার প্রতিনিধি নির্বাচিত করে। ডামি প্রার্থী দেওয়া তো এ ধরনের সিলেকশন, ইলেকশন নয়। এতে ভোট প্রতিদ্বন্দ্বিতা পূর্ণ হবে না, কেন্দ্রে ভোটারও আনা যাবে না। কিন্তু বিদ্রোহী প্রার্থীর আশকারা আওয়ামী লীগকে ভবিষ্যতে ভোগাবে। 


জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক গোবিন্দ চক্রবর্তী আজকের পত্রিকাকে বলেন, সরকারের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে নির্বাচনটা সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করা। এখানে যেহেতু অনেক রাজনৈতিক দল অংশ নিচ্ছে না কিন্তু তারপরেও ভোটাররা যাতে ভোট কেন্দ্রে আসে এ জন্য দল সমর্থিতদের নির্বাচন করার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী চান একটা অহিংস নির্বাচন। যার মাধ্যমে প্রকৃত অর্থে প্রতিনিধি নির্বাচন হন সেই বিষয়ে জোর দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে তিনি ডামি প্রার্থীদের ব্যাপারে ইতিবাচক একটা দৃষ্টি রয়েছে। 


স্বতন্ত্র ও ডামি প্রার্থীর বিষয়ে সহিংসতার আশঙ্কার বিষয়ে জানতে চাইলে দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, এতে সহিংসতার আশঙ্কা দেখি না। এখানে নির্বাচন করবে। যার যার ভোট শান্তিপূর্ণভাবে চাইবে, মিছিল-মিটিং করবে। ভোট কেন্দ্রে জনগণ যাকে ভোট দেয় সেই বিজয়ী হবে। 


শেয়ার করুন