২৮ এপ্রিল ২০২৪, রবিবার, ০৭:৩৩:১৮ অপরাহ্ন
পোশাকশিল্পে অনড় অবস্থানে মালিক ও শ্রমিক
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৩-১১-২০২৩
পোশাকশিল্পে অনড় অবস্থানে মালিক ও শ্রমিক

রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্প শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নিয়ে সৃষ্ট সংকটের কোনো সমাধান হয়নি। শ্রমিকরা ন্যূনতম সাড়ে ১২ হাজার টাকা বেতন বৃদ্ধির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন করছে। মালিকপক্ষ বলছেন, সাড়ে ১২ হাজার টাকার উপরে বেতন বৃদ্ধি তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তারা অব্যাহত শ্রমিক আন্দোলনের মুখে শক্ত অবস্থান নিয়ে ইতোমধ্যে শতাধিক পোশাক কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে। এমনকি নতুন শ্রমিক নিয়োগ বন্ধের সিদ্ধান্তও নিয়েছে। মালিকপক্ষের পাশাপাশি শ্রমিকরাও তাদের অধিকার আদায়ে হার্ডলাইনে রয়েছেন।


ন্যূনতম মজুরি ২৩,০০০ টাকা নির্ধারণের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন পোশাকশ্রমিকরা। দুপক্ষের এই অনড় অবস্থানের মধ্যেই গতকাল রবিবার ১২,৫০০ টাকা ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করে এই খাতের খসড়া বেতন প্রস্তাবনা গেজেট আকারে প্রকাশ করেছে সরকার। এতে আগামী ১৪ দিনের মধ্যে আপত্তি দাখিলের জন্য বলা হয়েছে। পোশাকশিল্প শ্রমিকপক্ষের নেতারা বলছেন, তারা সাড়ে ১২ হাজার টাকা বেতন কাঠামো মানবেন না। এ ব্যাপারে লিখিত আপত্তি ন্যুনতম মজুরী বোর্ডে দাখিল করবেন। মালিকপক্ষ বলছেন, তারা সাড়ে ১২ হাজার টাকার বেশি বেতন দিতে পারবেন না। দু’পক্ষের এই অনড় অবস্থানের ফলে পোশাকশিল্পে সৃষ্ট অনিশ্চয়তা কবে কাটবে- এটাই এখন বড় প্রশ্ন।


এদিকে শনিবার দিনগত রাত ১টার দিকে আরেকজন শ্রমিক নিহতের ঘটনা ঘটেছে। মো. জামাল উদ্দিন নামের ওই শ্রমিক গাজীপুরে বিক্ষোভ-সংঘর্ষের সময় আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। এ নিয়ে গত ২৩ অক্টোবর থেকে চলমান আন্দোলনে ৪ জন শ্রমিকের মৃত্যু হলো। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন কয়েকশ।


বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পোশাকশিল্পে ক্রয়াদেশ পাওয়ার মৌসুম এখনই। এ সময়ে মজুরি বৃদ্ধি নিয়ে এই জটিলতা


দু’পক্ষ তথা দেশের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে। এমন অবস্থায় রপ্তানিমুখী শিল্পকে বাঁচাতে মালিক ও শ্রমিক উভয় পক্ষকে আলোচনায় বসে সংকট সমাধান করতে হবে।


পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ গতকাল রবিবার সংবাদ সম্মেলনে বলেছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে বন্ধ পোশাক কারখানা খুলবে না। এ ছাড়া পোশাকশিল্পকে ঘিরে যারা চক্রান্ত করছে তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং কারখানা চালানোর জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে বিজিএমইএ।


সংগঠনের সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘আমরা লক্ষ্য করছি, মজুুরি বৃদ্ধির পরও আন্দোলনের নামে বিভিন্ন কারখানায় ভাঙচুর করা হচ্ছে। অজ্ঞাতনামা কিছু লোক কয়েকটি কারখানার ভেতরে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে।’


তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকরা কাজ না করলে বা কাজ না করে কারখানা থেকে বের হয়ে গেলে বা কারখানা ভাঙচুর করলে কারখানা কর্তৃপক্ষ শ্রমআইনের ১৩ (১) ধারায় কারখানা বন্ধ রাখতে পারবেন উল্লেখ করে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, যত দিন না ভাঙচুর বন্ধ হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারছে, ততদিন পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ শিল্প ও সম্পদ রক্ষায় কারখানা বন্ধ রাখতে পারবেন।


তিনি বলেন, যেহেতু বর্তমানে অনেক কারখানায় কাজ কম, ক্রেতারা নতুন করে কার্যাদেশ দেওয়া বন্ধ রেখেছেন, সেহেতু নতুন নিয়োগ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে।


মজুরি বৃদ্ধি প্রসঙ্গে ফারুক হাসান বলেন, ‘আমরা গত ৩১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দিয়েছিলাম, সরকার নতুন যে বেতন কাঠামো ঘোষণা করবে, আমরা পোশাকশিল্পের সব উদ্যোক্তা সেটিই মেনে নেব। আমরা ঘোষিত মজুরি মেনে নিয়েছি। যদিও বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই মজুরি বাস্তবায়ন করা অনেক উদ্যোক্তার জন্যই অত্যন্ত কষ্টসাধ্য হবে।’


শ্রমিকদের এ মজুরি মেনে নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনারা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে উৎপাদন বাড়ান এবং শিল্পকে টিকে থাকতে সহায়তা করুন। শিল্প ভালো থাকলে আপনারাও ভালো থাকবেন।’


বিজিএমইএর সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, শ্রমিকরা কারখানা ভাঙচুর করছে। কাজে না গিয়ে আন্দোলন করছে। এমন পরিস্থিতিতে কারখানা বন্ধ করা ছাড়া পথ নেই। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতির কারণে অর্ডার বাতিল হবে, ক্রেতারা অন্য দেশে চলে যাবে। এখনই অর্ডার আসার মৌসুম। দেশের পোশাক কারখানা কাজ হারাবে।


এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মজুরি যা বেড়েছে তাতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। কিস্তু ক্রেতারা বাড়তি দামে কিনতে চায় না। ফলে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে।


এদিকে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘সাড়ে ১২ হাজার টাকায় শ্রমিকদের একটি পরিবারের খরচ কোনোভাবেই মেটানো সম্ভব নয়। সুতরাং এটি পুনর্বিবেচনার সুযোগ রয়েছে। আমি মনে করি, মালিক প্রতিনিধি ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে মিলে যে প্রস্তাবনাটি এসেছে তা পুনর্বিবেচনার নির্দেশ দেবেন সরকারপ্রধান।’


বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার বলেন, ‘মালিকরা শ্রমিকদের দাবি মেনে নিলেই সংকটের সমাধান হবে। উভয়পক্ষের আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হবে। একই সঙ্গে শ্রমিক হত্যার বিচার, মামলা, হামলা ও হয়রানি বন্ধ করতে হবে। তা হলেই শ্রমিকরা কাজে যোগ দেবেন। শ্রম আইনে ১৪ দিনের যে সময় আছে তাতে বেতন কাঠামো পুনর্বিবেচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত গেজেট প্রকাশ করার দাবি জানাচ্ছি।’


এদিকে গতকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, শ্রমিকদের এই আন্দোলনে বিএনপির ইন্ধন রয়েছে। মালিকপক্ষের প্রতিনিধি বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমানও বলেছেন,


একটি চক্র ভিন্নখাতে নেওয়ার জন্য কিছু সাধারণ শ্রমিককে ইন্ধন দিচ্ছে। দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্যই এমন করা হচ্ছে। অর্থনীতি ও রাজনীতি এক সঙ্গে চলতে হবে।


জানা গেছে, প্রতি পাঁচ বছর অন্তর পোশাকশিল্প খাতে ন্যূনতম মজুরি কাঠামো ঘোষণা করা হয়। প্রতিবারই দেখা গেছে, শ্রমিকরা একটি অঙ্ক চেয়ে আন্দোলনে নামেন, মালিকপক্ষ দিতে চান তার চেয়ে অনেক কম।


ন্যূনতম মজুরি বোর্ডে দুই পক্ষের প্রস্তাবের পর দর কষাকষি করে একটি মজুরি ঘোষণা করা হয়। এরপরও শ্রমিক-বিক্ষোভ চলতে থাকে। এতে প্রতিবারই একাধিক শ্রমিকের প্রাণ ঝরে। এবারও শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। এবার শ্রমিকপক্ষ ন্যূনতম মজুরি ২৩,০০০ টাকা দাবি করলে বিজিএমইএ প্রথমে ১০ হাজার ৪০০ এবং পরে শ্রমিক-বিক্ষোভের মুখে ১২ হাজার ৫০০ টাকা দেওয়ার প্রস্তাব করে।

শেয়ার করুন