২৯ এপ্রিল ২০২৪, সোমবার, ০৩:০৫:৪১ পূর্বাহ্ন
রাজপথের চেয়ে রাজনীতি বেশি সামাজিক মাধ্যমে
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৫-০৮-২০২৩
রাজপথের চেয়ে রাজনীতি বেশি সামাজিক মাধ্যমে

বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এখন মিছিল-সমাবেশের চেয়ে বেশি সক্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তথ্যপ্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান প্রসারের সুযোগে দলগুলো এখন ফেসবুক, ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মেও অর্থ ও সময় ব্যয় করছে। এতে প্রচলিত একমুখী যোগাযোগব্যবস্থার বদলে কর্মী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে দলগুলোর বহুমুখী যোগাযোগ গড়ে উঠছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দলগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার আরও বাড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।


গত কয়েক মাসে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমাবেশগুলোতে মানুষের উপস্থিতি যা ছিল তার চেয়ে অনেক বেশিসংখ্যক মানুষ ওই সব সমাবেশ দেখেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সম্প্রচার হওয়ার সুবাদে। বিভিন্ন সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্যও প্রচারিত হচ্ছে এসব মাধ্যমে। আগে বিভিন্ন স্থানে পোস্টার লাগিয়ে প্রচার চালানো হলেও এখন সেগুলো ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে।


অন্যদিকে যেসব কর্মী-সমর্থক দলগুলোর সভা-সমাবেশে যোগ দিতে পারেন না, তাঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমাবেশের দৃশ্য সরাসরি দেখতে পান। সেই সঙ্গে নিজের মন্তব্য জুড়ে দেওয়ারও সুযোগ থাকছে।


পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী (২২) প্রায়ই রাজনৈতিক বিষয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেন। তবে তিনি কখনো সভা-সমাবেশে যান না। তাঁর পছন্দের দলের কার্যক্রমসংক্রান্ত তথ্য তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে পেয়ে যান। ওই শিক্ষার্থী জানান, তাঁর ক্যাম্পাস ঢাকার বাইরে হওয়ায় তিনি চাইলেও দলীয় সভা-সমাবেশে সরাসরি অংশ নিতে পারেননি। কিন্তু পছন্দের দলের পক্ষে তিনি ফেসবুকে সক্রিয়।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক কাবেরী গায়েন আজকের পত্রিকাকে বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন বড় একটি নিয়ামক হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য। শুরুতে প্রযুক্তির পরিবর্তন কেউ মানতে চায় না। পরে আস্তে আস্তে এটি গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। গ্রামের একজন মানুষও এখন খুব সহজেই এই মাধ্যমে তথ্য পাচ্ছেন।


দলগুলোর ফেসবুক পেজের চিত্র সোশাল মনিটরিং প্ল্যাটফর্ম ক্রাউডট্যাংগেল থেকে পাঁচটি প্রধান রাজনৈতিক দলের ৩১ দিনের (১৫ জুলাই-১৪ আগস্ট) তথ্য নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। দলগুলো হলো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), জাতীয় পার্টি (জাপা), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর ফেসবুক পেজ ভেরিফায়েড।


পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ২০১৩ সালের ৩০ আগস্ট খোলা আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজে অনুসারী ৩৩ লাখ। বিএনপির ফেসবুক পেজে অনুসারী ২১ লাখ। পেজটি খোলা হয় ২০১৯ সালের ১৩ জুন। ২০১৪ সালের ২০ জুন খোলা জামায়াতের ফেসবুকে অনুসারী ২০ লাখ। ২০১৫ সালের ৬ এপ্রিল খোলা সিপিবির ফেসবুকে অনুসারী ১৯ হাজার।


জাতীয় পার্টির ফেসবুকে অনুসারী ২৫ হাজার। পেজটি খোলা হয়েছে ২০২২ সালের ২১ নভেম্বর। এক বছরের কম হওয়ায় ‘মেটা টুল’ থেকে এই পেজের তথ্য পাওয়া যায়নি।


জাতীয় পার্টির তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক এলাহান উদ্দিন বলেন, তাঁদের পেজ নতুন করে করা হয়েছে। এক মাসের মধ্যে অনুসারী বাড়বে। নির্বাচন সামনে রেখেও কাজ চলছে।


কয়েকটি দল অন্যান্য মাধ্যমেও সক্রিয়। আওয়ামী লীগের ইউটিউব চ্যানেলে অনুসারী ২ লাখ ১৪ হাজার। বিএনপির ইউটিউব চ্যানেলে অনুসারী ৯ লাখ ২৪ হাজার। জামায়াতের অনুসারী ২ লাখ ১৫ হাজার। জাপার কোনো ইউটিউব চ্যানেল নেই।


অন্যদিকে টুইটারে (বর্তমানে এক্স) আওয়ামী লীগের একটি অ্যাকাউন্ট আছে, যার অনুসারী ৬ লাখ ২৮ হাজার ৩০০। বিএনপির অ্যাকাউন্টে অনুসারী ৩১ হাজার ২০০, জামায়াতের ৮৩ হাজার। এসব অ্যাকাউন্ট থেকে নিয়মিত বিভিন্ন বিষয় পোস্ট করছে দলগুলো। 

ইনস্টাগ্রামে আওয়ামী লীগের অনুসারী ৪ হাজার ২৮৭, বিএনপির ৪৯ হাজার ৩০০ এবং জামায়াতের ১৯ হাজার ৬০০ জন।


পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া এখন দলের শীর্ষ নেতারা সরাসরি দেখতে বা শুনতে পাচ্ছেন। ফেসবুকে দেওয়া বিভিন্ন পোস্টে সমর্থনের পাশাপাশি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায়ও দেখা যায়।


আওয়ামী লীগের পোস্টগুলোতে ১২ লাখ ১৯ হাজার ৭২৬ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। বিএনপির পোস্টগুলোতে প্রতিক্রিয়া আছে ৯৮ লাখ ২৬ হাজার ৬৩৪।  


জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও ডিজিটাল মিডিয়া গবেষক মো. সাঈদ আল-জামান বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন দলগুলোর রাজনৈতিক যোগাযোগের শক্তি বাড়িয়ে দিচ্ছে। একই সঙ্গে যাঁরা সম্ভাব্য ভোটার, তাঁদেরও শক্তিশালী করেছে।


সবাই এখানে সরাসরি মতামত দিতে পারছেন। প্রচলিত গণমাধ্যমের বাইরে একমুখী যোগাযোগ থেকে বেরিয়ে এখানে বহুমুখী উপায়ে যোগাযোগ হচ্ছে। 


ফেসবুকে দলীয় তথ্য 

৩১ দিনের পোস্ট পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ফেসবুকে আওয়ামী লীগ মোট ৯৭৯টি পোস্ট দিয়েছে। এর মধ্যে ছবি ৭০২টি, ভিডিও ২১৭টি, সম্পূর্ণ লাইভ ভিডিও ৫৩টি, খবরের লিংক ৭টি। প্রতিদিন গড়ে ৩২টি পোস্ট করা হয়েছে।


আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া বলেন, আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজটি চালায় মূলত সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই)। তিনি বলেন, এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম খুবই সক্রিয়। জাতীয় নির্বাচনে তাঁরা প্রচার আরও বাড়াবেন এখানে। ফেসবুকে তাঁরা নেতিবাচক বিভিন্ন বিষয় তদারকি করেন।


বিএনপির পেজে ৩১ দিনে ৬৭৬টি পোস্ট হয়েছে। এর মধ্যে সম্পূর্ণ লাইভ ভিডিও ৩০৮টি, ছবি ২৩৫টি, ভিডিও ১২৬টি, খবরের লিংক ৩টি এবং লাইভ ভিডিও, স্ট্যাটাস, ইউটিউব লিংক ১টি করে। দিনে গড়ে ২২টি পোস্ট করা হয়েছে।


বিএনপির মিডিয়া উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবির খান বলেন, তাঁদের একটি টিম আছে। এই টিম সামাজিক মাধ্যমগুলো নিয়ে কাজ করে। সেখান থেকেই যাবতীয় পোস্ট দেখেশুনে করা হয়।


জামায়াতের ৩১৮টি পোস্টের মধ্যে ১৮৮টি ছবি, ভিডিও ৯টি, সম্পূর্ণ লাইভ ভিডিও ১৯টি, স্ট্যাটাস ১২টি, লাইভ ভিডিও ১টি। 

জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, তাঁদের একজন কর্মী নিয়োজিত আছেন ফেসবুক পেজ চালানোর জন্য। তবে নির্বাচনকেন্দ্রিক তাঁদের কোনো প্রচারণা বা পরিকল্পনা এখনো নেই।


সিপিবির পেজে ২৭টি পোস্টের মধ্যে ছবি ২৫টি, লিংক ও লাইভ ভিডিও ১টি করে।


সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স মনে করেন, ফেসবুকে সময় নষ্ট হয়। তিনি বলেন, ‘এটা ঠিক যে প্রয়োজনের তুলনায় আমাদের কার্যক্রম কম। কারণ আমাদের কর্মীদের সময় যায় মূলত আন্দোলন-সংগ্রাম ও সংগঠন গড়ে তুলতে। এটাই প্রধান কাজ। তবে সম্প্রতি আমরা ডিজিটাল মিডিয়ার ব্যবহার বাড়াতে উদ্যোগ নিয়েছি।’


কাবেরী গায়েন মনে করেন, প্রচলিত গণমাধ্যমে তথ্য ফিল্টার করা হয়। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমগুলোতে সেই দায় না থাকায় বিপদ থেকে যায় অপতথ্য ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রভাবিত করার। অনেক কর্মী-সমর্থক ফেসবুকে নিজের দল কিংবা সরকারের সমালোচনা করলেও মাঠে তাদের সক্রিয়তা না থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা ভাবা ভুল যে সামাজিক মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া আছে আর মাঠে নেই। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বড় দুটি দলের কর্মী-সমর্থকেরা নির্বাচনের সময় সবভাবেই সক্রিয় থাকেন।


তথ্যপ্রযুক্তিবিদ তানভীর হাসান জোহা বলেন, ডিজিটাল মিডিয়া একটি চলমান ধারা। এখানে কোনো খরচ হচ্ছে না। পোস্টার লাগাতে গেলে টাকা খরচ হবে, শ্রম যাবে। অনেক ক্ষেত্রে সেটি কেউ ছিঁড়ে ফেলে। কিন্তু ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে এই সমস্যা নেই। এখানে সহজে অনেক কিছু বলা যাচ্ছে।


শেয়ার করুন