স্বপ্ন এখন দৃশ্যমান ॥ গভীর সমুদ্র বন্দর


, আপডেট করা হয়েছে : 26-02-2023

স্বপ্ন এখন দৃশ্যমান ॥ গভীর সমুদ্র বন্দর

গভীর সমুদ্রবন্দরের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন এখন দৃশ্যমান। দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা হচ্ছে কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ি ধলঘাট এলাকায়। বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে ১ হাজার ৩১ একর জায়গার নির্মাণ করা হচ্ছে এই বন্দরটি। মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ হলে ৮ হাজার ২০০ টিইইউএস ক্ষমতাসম্পন্ন কন্টেনার বহনকারী জাহাজ নোঙ্গর করতে পারবে।

ফলে পণ্য নিয়ে সিঙ্গাপুর, কলম্বো আর মালয়েশিয়ার বন্দরে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের আর অপেক্ষায় থাকতে হবে না। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় একটি পণ্যের চালান পাঠাতে সময় লাগে ৪৫ দিন। মাতারবাড়ি বন্দর চালু হলে মাত্র ২৩ দিনেই সরাসরি নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছে যাবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।    
মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প ২০২০ সালের ১০ মার্চ একনেক সভায় অনুমোদন দেয়া হয়। প্রকল্পে মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০২০ সালে জানুয়ারি থেকে ২০২৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক)। এ ছাড়া প্রকল্প এলাকায় সড়ক নির্মাণ করছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)।
এ বিষয়ে নৌ-প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, ‘মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর দৃশ্যমান হয়ে গেছে। ২০২৬ সালে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু হবে। এ লক্ষ্যে চলতি বছরের জুলাই নাগাদ জেটি ও কন্টেনার ইয়ার্ড নির্মাণ কাজ শুরু  হবে। এখানে বড় ধরনের ফিডার ভেসেল আসবে। অর্থ ও সময় বাঁচবে। অর্থনীতিতে সুপ্রভাব ফেলবে।’

এতে একমাত্র নীল পানির বন্দর মাতারবাড়ি ॥ সরেজমিনে মাতারবাড়ি বন্দর এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সমুদ্রপথে মাতারবাড়ির দূরত্ব ৩৪ নটিক্যাল মাইল। জাহাজে যেতে সময় লাগে ২-৩ ঘণ্টা। সড়কপথে এর দূরত্ব প্রায় ১১২ কিলোমিটার। সময় লাগে ২ থেকে আড়াই ঘণ্টা। কক্সবাজারের চকরিয়া থেকে মাতারবাড়ি ধলঘাট পর্যন্ত ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে সড়ক ও বন্দর নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ হয়েছে। সড়ক নির্মাণের জন্য বিভিন্ন স্থানে পাথর ও মাটি ভরাট করা হচ্ছে। 
এছাড়া এ বন্দরের অনেক কাজ এগিয়ে নিয়েছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পটি। বন্দরের জন্য যে চ্যানেল তৈরি হয়েছে সেটি ২৫০ মিটার চওড়া, ১৮ দশমিক ৫ মিটার গভীর এবং ১৪ দশমিক ৩ মিটার দীর্ঘ। সাগর থেকে উপকূল পর্যন্ত পাথর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে বাঁধ। মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর এলাকায় চ্যানেলের পানি পুরো নীল। দেশের আর কোনো বন্দরে এমন নীল পানি নেই। নীল পানি থাকা মানে নৌপথের বড় অংশে পলি জমার আশঙ্কা কম বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।

প্রকল্প সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে বন্দরের নিরাপত্তায় উত্তর ও দক্ষিণ দিকে নির্মাণ করা হয়েছে প্রায় তিন কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্রের ঢেউ প্রতিরোধ বাঁধ। প্রকল্পের বিশদ নকশা তৈরি কাজ শেষ হয়েছে। এ ছাড়া জেটি নির্মাণ, জাহাজ হ্যান্ডেলিং সরঞ্জাম সংগ্রহ ও টাগ বোট ক্রয়সহ তিনটি প্যাকেজে ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সকল প্রস্তুতি শেষে চলতি বছরের মাঝামাঝি সময় প্রকল্পের নির্মাণ কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 
এ বিষয়ে মাতারবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু হায়দার জনকণ্ঠকে বলেন, ‘কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ি লবণ চাষের জন্য বিখ্যাত। এই এলাকায় এখন সমুদ্রবন্দর ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র হচ্ছে। যা শুধু মহেশখালী নয় পুরো কক্সবাজারবাসীর জন্য গর্বের বিষয়। আগে মহেশখালীতে যাতায়াতের জন্য ভালো রাস্তা ছিল না। এখন বন্দর ও বিদু্যুৎ কেন্দ্রের জন্য চকরিয়া থেকে ধলঘাট পর্যন্ত চারলেনের রাস্তা করা হচ্ছে। যা মহেশখালীবাসী কখনো কল্পনা করতে পারেনি। ইতোমধ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ কাজে প্রায় ২-৩ হাজার স্থানীয় লোকের কর্মসংস্থান করা হয়েছে। এছাড়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে ১ হাজার ৩১ একর জায়গার অধিগ্রহণ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
প্রকল্প সূত্র জানায়, মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ হলে অন্যান্য বন্দর থেকে এর দূরত্ব বেশি হবে না। চট্টগ্রাম থেকে সমুদ্রপথে মাতারবাড়ির দূরত্ব ৩৪ নটিক্যাল মাইল, পায়রা বন্দর থেকে মাতারবাড়ির দূরত্ব ১৯০ নটিক্যাল মাইল ও মোংলাবন্দর থেকে গভীর সমুদ্রবন্দরের দূরত্ব ২৪০ নটিক্যাল মাইল। তাই মাতারবাড়িতে মাদার ভেসেল (বৃহদাকার কন্টেনার জাহাজ) থেকে পণ্য খালাস করে অল্প সময়ের মধ্যে সড়ক ও সমুদ্রপথে অন্যান্য বন্দরে পরিবহন করা যাবে। পুরোদমে মাতারবাড়ি বন্দর চালু হলে দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। পরিসংখ্যান বলছে গভীর সমুদ্রবন্দর জাতীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে ২-৩ শতাংশ অবদান রাখবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান জনকণ্ঠকে বলেন, ‘বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিগুলোতে সাধারণত মাত্র ৯ দশমিক ৫ মিটার ড্রাফটবিশিষ্ট জাহাজ বার্থ করতে পারে। তবে সম্প্রতি ১০ মিটার ড্রাফটের একটি জাহাজ ভেড়ানো হয়েছে। কিন্তু এসব জাহাজ ৮০০ থেকে সর্বোচ্চ ২৪০০ টিইইউএস কন্টেনার বহন করতে পারে। একটি মাদার ভেসেলের ধারণক্ষমতা ৮০০০ থেকে ১০ হাজার টিইইউএস কন্টেনার। মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ হলে ৮ হাজার টিইইউসের বেশি সক্ষমতাসম্পন্ন কন্টেনার বহনকারী জাহাজ নোঙ্গর করতে পারবে। সহজেই আসতে পারবে বৃহদাকার কন্টেনার জাহাজ।’ 
জাপানি সহায়তায় নির্মাণ হচ্ছে গভীর বন্দর ॥ মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ১৬ লাখ ১৩ হাজার টাকা। এর মধ্যে সমুদ্রবন্দর নির্মাণে ব্যয় হবে ৮ হাজার ৯৫৫ কোটি ৮২ লাখ টাকা। বন্দর নির্মাণে জাপানি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকা ঋণ সহায়তা দিবে ৬ হাজার ৭৪২ কোটি ৫৬ লাখ ৭৯ হাজার টাকা। বাকি ২ হাজার ২১৩ কোটি ২৪ লাখ ৯৪ হাজার টাকা দিবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক)।
এছাড়া বন্দর এলাকায় সড়ক নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৮২১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে সড়ক নির্মাণে জাইকা ঋণ সহায়তা দিবে ৬ হাজার ১৫০ কোটি ১৯ লাখ টাকা। বাকি ২ হাজার ৬৭১ কোটি ১৫ লাখ সড়ক ও জনপথের (সওজ) ফান্ড থেকে ব্যয় করা হবে। বন্দর ও সড়ক নির্মাণে জাপান সরকার মোট ঋণ সহায়তা দিবে ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। 
এ বিষয়ে নৌ-প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা হবে। এখনকার স্মার্ট দেশ সিঙ্গাপুরকে ছাড়িয়ে যাবে। মাতারবাড়ি বন্দর বাণিজ্যিক হাব হবে। চট্টগ্রাম বন্দর হবে অর্থনীতির লাইফ লাইন। গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের লক্ষ্যে ৩৫০ মিটার প্রশস্ত ও ১৬ মিটার গভীরতা সম্পন্ন ১৪ দশমিক ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ অ্যাপ্রোচ চ্যানেলের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়াও অ্যাপ্রোচ চ্যানেলের উত্তর পাশে ২ হাজার ১৫০ মিটার দীর্ঘ ও দক্ষিণ পাশে ৬৭০ মিটার দীর্ঘ ব্রেক ওয়াটার (ঢেউ নিরোধক বাঁধ) নির্মাণের কাজ সমাপ্ত হয়েছে। বর্তমানে ৪৬০ মিটার দীর্ঘ কন্টেনার জেটি ও ৩০০ মিটার দীর্ঘ মাল্টিপারপাস জেটি নির্মাণ এবং কন্টেইনার ইয়ার্ডসহ সকল বন্দর সুবিধাদি নির্মাণের জন্য তিনটি প্যাকেজে দরপত্র আহবান করা হয়েছে।
বন্দরের জন্য নির্মাণ হচ্ছে ২৭ কিলোমিটার সড়ক ॥ মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরে সড়ক পথে যাতায়াত সহজ করার জন্য কক্সবাজারের চকরিয়ার ফাসিয়াখালী থেকে মাতারবাড়ি পর্যন্ত নির্মাণ করা হচ্ছে ২৭ দশমিক ২ কিলোমিটার সড়ক। এর মধ্যে মাতারবাড়ি বন্দর থেকে ধলঘাট গোলচত্বর পর্যন্ত সোয়া ১ কিলোমিটার দীর্ঘ সংযোগ সড়ক চারলেনে উন্নতি করা হবে। এছাড়া ধলঘাট থেকে ফাসিয়াখালী পর্যন্ত পণ্য পরিবহনের জন্য ২ লেনের ২৬ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হবে। যা ভবিষ্যতে ৪ লেনের মহাসড়কে উন্নতি করা হবে বলে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) কর্মকর্তারা জানান। 
এ বিষয়ে সওজের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচারক মো. জাকির হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, ‘তিন প্যাকেজে মাতারবাড়ি বন্দর সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। মাতারবাড়ি থেকে চকরিয়ার ফাসিয়াখালী পর্যন্ত ২৭ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করে এটি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার চারলেন মহাসড়কের সঙ্গে যুক্ত করা হবে। সড়কটি নির্মাণের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।’ এই সড়ক বাস্তবায়ন হলে বন্দর পণ্য সড়কপথে দেশের যে কোনো স্থানে পরিবহন করা যাবে বলে জানান তিনি।
প্রকল্প সূত্র জানায়, সড়ক নির্মাণের তিনটি প্যাকেজ মধ্যে বন্দরের উত্তর-দক্ষিণে সংযোগের জন্য ১ দশমিক ১৫ কিলোমিটার চারলেনের সড়কটি নির্মাণ করা হচ্ছে সিডাব্লিউ-৩এ প্যাকেজে। এই প্যাকেজের আওয়ায় আরও প্রায় সাড়ে ১০ কিলোমিটার ২ লেনের সড়ক নির্মাণ করা হবে। এছাড়া ৩০০ মিটার দৈর্ঘ্যরে চারটি সেতু, ২টি গোলচত্বর ও একটি রেলওভারপাস নির্মাণ করা হবে। প্যাকেজ সিডাব্লিউ-৩বি’র আওতায় ৬ দশমিক ৪০ কিলোমিটার দুই লেনের সড়ক, চারটি সেতু ও একটি রেলওভার পাস নির্মাণ করা হবে। প্যাকেজ সিডাব্লিউ-৩সির আওতায় ৯ দশমিক ১২ কিলোমিটার ২ লেনের সড়ক, ৬ সেতু ও একটি রেলওভার পাস নির্মাণ করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান।

 


  • সম্পাদক ও প্রকাশক: ইঞ্জিনিয়ার মো: রায়হানুল ইসলাম

  • উপদেষ্টাঃ মোঃ ইব্রাহীম হায়দার