মোবাইল হ্যান্ডসেট: সাংবাদিক আটক নিয়ে দিনভর আলোচনা


, আপডেট করা হয়েছে : 20-11-2025

মোবাইল হ্যান্ডসেট: সাংবাদিক আটক নিয়ে দিনভর আলোচনা

গত মঙ্গলবার (১৮ নভেম্বর) মধ্যরাতে বাসা থেকে ডিবি আটক করে ভোরের কাগজের অনলাইন প্রধান মিজানুর রহমান সোহেলকে। এই আটকের ঘটনার পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টার টেলিকম ও আইসিটি বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যবের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠে।


পাশাপাশি ন্যাশনাল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিফিকেশন রেজিস্ট্রার (এনইআইআর) চালু করা নিয়ে বুধবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলন ছিল। সেই সংবাদ সম্মেলন বন্ধ করার জন্য সাংবাদিক সোহেলকে আটক করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়।


তবে এই ঘটনার সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব বলেছেন, "তার বিরুদ্ধে 'অসত্য' তথ্য প্রচার করা হচ্ছে, যা জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই একটি ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে কোনো কোনো গণমাধ্যম আমার ওপর দায় চাপিয়েছে। তাদের উদ্দেশেই আমার বক্তব্য, এটা অনভিপ্রেত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের কাজ করে। এখানে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা থাকার অবকাশই নেই।"


এনইআইআর কী: ন্যাশনাল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিফিকেশন রেজিস্ট্রার সংক্ষেপে এটাকে এনইআইআর বলা হয়। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন আগামী ১৬ ডিসেম্বর থেকে এটা বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছে। এটি চালু হলে দেশের মোবাইল নেটওয়ার্কে নিবন্ধনবিহীন, চুরি হওয়া বা আমদানি অননুমোদিত ফোনের ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাবে।


এনইআইআর এমন একটি কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা, যা প্রতিটি হ্যান্ডসেটের আন্তর্জাতিকভাবে অনুমোদিত আইএমইআই নম্বরকে ব্যবহারকারীর জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ও ব্যবহৃত সিমের সঙ্গে যুক্ত করে নিবন্ধিত করবে। ফলে বৈধ ও অবৈধ হ্যান্ডসেট সহজেই চিহ্নিত করা সম্ভব হবে।


এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে বিটিআরসির পাশাপাশি চারটি মোবাইল অপারেটর-গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংক ও টেলিটক নিজস্ব ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্ট্রার (ইআইআর) ব্যবস্থা উন্নয়নে কাজ করছে।


ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, 'এই ব্যবস্থা চালু হলে অবৈধভাবে আমদানি করা বা নকল মুঠোফোনের ব্যবহার বন্ধ হয়ে যাবে। এতে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি কমবে এবং দেশীয় হ্যান্ডসেট উৎপাদনশিল্প আরো সুরক্ষিত হবে। পাশাপাশি চুরি হওয়া বা অপরাধমূলক কাজে ব্যবহৃত ডিভাইস দ্রুত শনাক্ত ও ব্লক করা সম্ভব। হবে। এর মাধ্যমে অপরাধ দমনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এই ব্যবস্থা।'


এনইআইআর চালুর ফলে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) জালিয়াতি, সিম প্রতারণা ও স্ক্যাম কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করা যাবে। একই সঙ্গে ই-কেওয়াইসি যাচাই আরো শক্তিশালী হবে, টেলিকম সেক্টরের নিরাপত্তা জোরদার হবে এবং সরকারি রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি পাবে।


বিটিআরসির স্পেকট্রাম বিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আমিনুল হক বলেন, 'পরবর্তী সময় নতুন যেসব হ্যান্ডসেট নেটওয়ার্কে যুক্ত হবে, তা প্রাথমিকভাবে নেটওয়ার্কে সচল রেখে এনইআইআরের মাধ্যমে বৈধতা যাচাই করা হবে। হ্যান্ডসেট বৈধ হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিবন্ধিত হয়ে নেটওয়ার্কে সচল থাকবে।'


বাস্তবায়নে বাধা কোথায়: এনইআইআর বাস্তবায়ন হলে অবৈধভাবে যারা হ্যান্ডসেট আমদানি করেন তাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। পাশাপাশি তাদের গোডাউনে থাকা হ্যান্ডসেটগুলোও পরিত্যক্ত হয়ে যাবে। ফলে যাদের হেফাজতে এই হ্যান্ডসেট রয়েছে তাদের ব্যাপক ক্ষতি হবে। পাশাপাশি দেশের কারখানাগুলো যে হ্যান্ডসেট উৎপাদন হয় এবং যারা বৈধভাবে বিদেশ থেকে হ্যান্ডসেট আমদানি করেন তারা এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারবেন।


ফলে ব্যবসায়ীদের একটা গ্রুপ এনইআইআর বাস্তবায়ন না করার জন্য কয়েক দিন ধরে আন্দোলন করে আসছে। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বুধবার দুপুরে 'মোবাইল বিজনেস কমিউনিটি' ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিল। মিজানুর রহমান সোহেল এই ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করছিলেন।


মঙ্গলবার রাত ১২টায় আটকের ১০ ঘণ্টা পর মুক্তি পেয়ে মিজানুর রহমান সোহেল বলেন, মোবাইল বিজনেস কমিউনিটির সংবাদ সম্মেলনের আয়োজনের সঙ্গে তিনি যুক্ত। ডিবির কার্যালয়ে তাকে নিয়ে গিয়ে কর্মকর্তারা এই সংবাদ সম্মেলনের বিষয়ে কথা বলেন। ডিবির কর্মকর্তাদের কথায় তার মনে হয়েছে, ওপরের মহলের নির্দেশনায় তারা চান, এই সংবাদ সম্মেলন না হোক। এজন্য তাকে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ দেওয়া হয়েছে।


সরকারকে আলোচনায় বসার আহ্বান: মোবাইল বিজনেস কমিউনিটির যে সংবাদ সম্মেলন 'ঠেকাতে' দুই জনকে ধরে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ, সেই সংবাদ সম্মেলন করেছে মোবাইল ফোন বিক্রেতাদের সংগঠনটি। সেখান থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবের বিরুদ্ধে। তারা অভিযোগ করেন, কমিউনিটির সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদ পিয়াস দুপুর পর্যন্ত ডিবি হেফাজতেই ছিলেন।


ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) শফিকুল ইসলাম বলেন, আবু সাঈদ ডিবি কার্যালয়ে রয়েছেন। তার সঙ্গে তারা কথা বলছেন। তবে কী নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা হচ্ছে, তা তিনি বলেননি।


মোবাইল বিজনেস কমিউনিটির সিনিয়র সহসভাপতি শামীম মোল্লা বলেন, এনইআইআর বাস্তবায়নে তারা বাধা হতে চান না। কিন্তু যেভাবে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা সরকার করছে, তার পুনর্গঠন চান তারা। তাদের হাতে থাকা হ্যান্ডসেটগুলো বিক্রির জন্য এক বছর সময় চান তারা। তারা চান প্রধান উপদেষ্টা তাদের আলোচনায় ডাকুক, তাদের উদ্বেগগুলো শুনুক।


বিদ্যমান করনীতি অনুসারে এনইআইআর বাস্তবায়ন হলে দেশের সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফোনের দাম অনেক বেড়ে যাবে। এই সিদ্ধান্ত থেকে সরকার পিছু না হটলে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেন, এই দেশের ২০ কোটি জনগণের মোবাইলের ভাগ্য কেন শুধু ১৮ জন লাইসেন্সধারীকে দেওয়া হবে? মোবাইল বিজনেস কমিউনিটির এই সংবাদ সম্মেলনে দেশের বিভিন্ন মার্কেটের ব্যবসায়ীরা উপস্থিত ছিলেন।


মোবাইল মার্কেট বন্ধ ও খোলা রাখার পালটাপালটি ঘোষণা: স্মার্টফোন ও গ্যাজেট ব্যবসায়ীদের সংগঠন মোবাইল বিজনেস কমিউনিটি বাংলাদেশ (এমবিসিবি) গতকাল সংবাদ সম্মেলন থেকে ধর্মঘটের ঘোষণা দেন। রাজধানীর মোবাইল মার্কেটের একাংশ বন্ধ থাকায় দুর্ভোগে পড়েছে ক্রেতারা। বিশেষ করে বসুন্ধরা সিটি মোবাইল মার্কেটসহ অন্য বৃহৎ বাজারগুলোতে ক্রেতাদের ভিড় দেখা গেলেও ফটকের কাছে এসেই তারা জানতে পারেন মার্কেট বন্ধের কথা। এছাড়া, অনেকে আসছেন মোবাইল সারাতে, তারাও কাঙ্ক্ষিত সেবা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন।


অন্যদিকে, মোবাইল ফোন উৎপাদনকারীদের সংগঠন এমআইওবি (মোবাইল ফোন ইন্ডাস্ট্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) জানিয়েছে, সারা দেশে বৈধ মোবাইল ফোন উৎপাদনকারী ও আমদানিকারকদের দোকান খোলা রয়েছে এবং সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছাড়া খোলাই থাকবে। এমআইওবির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু মহল থেকে বিভ্রান্তিকরভাবে প্রচার করা হচ্ছে যে সারা দেশের মোবাইল ফোনের দোকান বন্ধ রয়েছে বা বন্ধ করে দেওয়া হবে।


এই তথ্য সম্পূর্ণ মিথ্যা, গুজবনির্ভর এবং ভোক্তাদের ভুল পথে পরিচালিত করার অপপ্রয়াস। আমরা দেশের সব সম্মানিত ক্রেতা ও অংশীজনকে নিশ্চিত করতে চাই, বাংলাদেশের বৈধ মোবাইল ফোন উৎপাদনকারী ও আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের সব অনুমোদিত বিক্রয়কেন্দ্র ও ব্যান্ড শপ স্ব-স্ব মার্কেটের নির্ধারিত সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন স্বাভাবিকভাবে খোলা রয়েছে এবং খোলা থাকবে। একই সঙ্গে বৈধ ডিলারদের অধীনস্থ দেশের সব রিটেইল দোকানও নিয়মিত খোলা আছে এবং স্বাভাবিকভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করছে।



  • সম্পাদক ও প্রকাশক: ইঞ্জিনিয়ার মো: রায়হানুল ইসলাম

  • উপদেষ্টাঃ মোঃ ইব্রাহীম হায়দার