নবমে বিভাগবিহীন, দশমে বিভাগের ধাক্কা


, আপডেট করা হয়েছে : 01-11-2025

নবমে বিভাগবিহীন, দশমে বিভাগের ধাক্কা

মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমান পরীক্ষা আগামী ৩০ এপ্রিল থেকে শুরু করার সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। দেশের ইতিহাসে এটাই প্রথম এসএসসি ব্যাচ, যারা নবমে বিভাগবিহীন পড়ালেখা করেছে। দশমে বিভাগ বিভাজনে পড়তে হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, দুই বছরের পড়া এক বছরে শেষ করার চাপেও পড়েছে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে যাওয়া প্রায় ১৫ লাখ শিক্ষার্থী। এবারও সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে হবে পরীক্ষা। এতে শিখন ঘাটতিতে পড়তে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষাবিদরা বলছেন, এই ঘাটতি পূরণ হওয়া সম্ভব নয়। সংক্ষিপ্ত সিলেবাস শিক্ষা খাতের জন্য অশনিসংকেত বয়ে আনছে।


এদিকে আগামী বছরের এসএসসি পরীক্ষা যারা দেবে, তাদের ফরম পূরণ শুরু হবে ৩১ ডিসেম্বর থেকে। ফরম পূরণ শুরু করতে এর একদিন আগে ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে স্কুলগুলোকে নির্বাচনি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করতে বলেছে শিক্ষা বোর্ডগুলো। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী আগামী ২৭ নভেম্বর থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এসএসসির নির্বাচনি পরীক্ষা হবে, আর ফল প্রকাশ করতে হবে ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে।


রাজধানীর একটি স্কুলের দশম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী আক্ষেপ করে বলে, 'নবম শ্রেণির এক বছর বিভাগবিহীন একটা সিলেবাসে পড়াশোনা করেছি। তারপর দশম শ্রেণিতে

ওঠার পর পেয়েছি বিভাগ বিভাজন, সিলেবাসও পরিবর্তন হয়েছে। সম্পূর্ণ নতুন পড়া। এছাড়া নতুন সিলেবাসের বই পেতে ফেব্রুয়ারি মাস পার হয়ে যায়। এক বছর পড়ে এসএসসি পরীক্ষা দিতে হবে, এই চিন্তা করে বছরের শুরু থেকে এক ধরনের মানসিক চাপে আছি।'


সাধারণত নবম-দশম শ্রেণিতে একই পাঠ্যবই ও শিক্ষাক্রম থাকে। নবমে একটি অংশ, দশমে একটি অংশ ভাগাভাগি করে পড়ে শিক্ষার্থীরা। নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে নির্বাচনি পরীক্ষা নিয়ে ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাসে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা নেওয়া হয়। কিন্তু এবার নবম শ্রেণিতে শিক্ষার্থীরা যে বই পড়েছে, দশমে তা সম্পূর্ণ ভিন্ন। পাঠ্যক্রম ও পদ্ধতি আলাদা। তারা নবম শ্রেণিতে বাতিল হওয়া 'নতুন শিক্ষাক্রম' পড়েছে। দশমে উঠে পড়ছে পরিমার্জন করা ২০১২ সালে প্রণীত 'সৃজনশীল শিক্ষাক্রম'। কে বিজ্ঞান বিভাগ নেবে, কে মানবিক, কে বাণিজ্য-সেটাও ঠিক করতে হয়েছে দশম শ্রেণিতে। কারণ ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় চালু করা 'নতুন শিক্ষাক্রমে' নবম-দশম শ্রেণির বিভাগ বিভাজন উঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যেটা ২০২৪ সালে চালু ছিল। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকারের পট পরিবর্তনের পর ঐ বছরের ১ সেপ্টেম্বর নতুন শিক্ষাক্রম 'বাস্তবায়ন যোগ্য নয়' ঘোষণা দিয়ে ২০২৫ সাল থেকে বিভাগ বিভাজন ফিরিয়ে আনে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে ২০২৬ সালের এসএসসি পরীক্ষার জন্য সংক্ষিপ্ত সিলেবাস, প্রশ্নের ধরন ও নম্বর বণ্টন প্রকাশ করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এদিকে এবার পরীক্ষা পিছিয়েছে। চলতি বছর এসএসসি পরীক্ষা হয়েছিল ১৬ এপ্রিল, আগামী বছর ৩০ এপ্রিল শুরু করার টার্গেট নির্ধারণ করা হয়েছে।


শিক্ষার্থীদের পাঠদান ও পরীক্ষার প্রস্তুতির ব্যাপারে কিছুটা ঘাটতি রয়েই গেছে: রাজধানীর নামকরা

একটি স্কুলের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, '২০২৬ সালের এএসসি পরীক্ষা নিয়ে আমরা চিন্তিত। হঠাৎ করে সিলেবাস পরিবর্তন, আবার সেই বই পেতেও দেরি হয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীদের পাঠদান ও পরীক্ষার প্রস্তুতির ব্যাপারে কিছুটা ঘাটতি রয়েই গেছে। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।'


অল্প সময়ে এমন বড় পরিবর্তন শিক্ষার্থীদের জন্য মঙ্গলময় নয়: অভিভাবকরা জানান, সাধারণত দুই বছর পড়াশোনার পর এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু ২০২৬ সালের এই এসএসসি ব্যাচ দেশের সবচেয়ে ব্যতিক্রম। কারণ তারা নতুন একটি সিলেবাস মাত্র এক বছর পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিচ্ছে। হঠাৎ নতুন সিলেবাস এবং সময় স্বল্পতা শিক্ষার্থীদের ওপর বিভিন্ন ধরনের চাপ সৃষ্টি করছে। শিক্ষার্থীদের স্বার্থে কারিকুলাম পরিবর্তন করা হলে যথেষ্ট সময় দেওয়া উচিত বলে মনে করেন অভিভাবকরা। ঢাকার একটি বেসরকারি স্কুলের বিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষার্থীর বাবা আজিজুল হক বলেন, 'আমার মেয়ে এমনিতেই একটু ধীরে সবকিছু বোঝে। তার এসএসসি পরীক্ষা নিয়ে আমি ও তার মা সব সময় চিন্তা করতাম। তার মধ্যে আগামী বছরের এসএসসিতে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন। মাত্র এক বছর পড়ে পরীক্ষা দিতে হবে। শুরুতে পরীক্ষার সিলেবাস ও নম্বর বিভাজন ছিল না। সব মিলিয়ে অল্প সময়ে এমন বড় পরিবর্তন শিক্ষার্থীদের জন্য মঙ্গলময় নয়।'


উচ্চ শিক্ষায় ধরা পড়ছে এসএসসি ও এইচএসসিতে শিখন ঘাটতির চিত্র: শিক্ষক, অভিভাবকসহ শিক্ষার নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বিশেষজ্ঞরা বলেন, ২০২০ সালের পর থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে অটোপাশ, সিলেবাস সংক্ষিপ্তকরণের মতো ঘটনা শিক্ষার মানে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের একজন অধ্যাপক বলেন, 'উচ্চশিক্ষার বিষয়বস্তু ভালোভাবে আয়ত্ত করার জন্য শিক্ষার্থীদের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে একটা ভালো ভিত্তি গড়ে ওঠা অত্যন্ত জরুরি। করোনাকালে অটোপাশ, সিলেবাস সংক্ষিপ্তকরণের মতো সিদ্ধান্তের কারণে এ জায়গাটিতে বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এখন আমরা ক্লাসে যখন শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছি, তখন অনেক শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে দেখতে পাই, তারা এমন অনেক বিষয় বুঝতে পারছে না, যেটি তাদের উচ্চমাধ্যমিক স্তরেই শিখে আসার কথা। এছাড়া আগের শিক্ষার্থীদের তুলনায় বর্তমান শিক্ষার্থীদের মধ্যে অমনোযোগিতার হারও বেশি।' জানা গেছে, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের জেরে ২০২০ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অটোপাশ দিয়েছিল তৎকালীন সরকার। আর ২০২১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমানের পরীক্ষা এবং উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) ও সমমানের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে। সবশেষ শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে জুলাই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে স্থগিত হওয়া ২০২৪ সালের এইচএসসির পরীক্ষাগুলোয় অটোপাশ দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। চলতি বছরের এইচএসসি পরীক্ষাও অনুষ্ঠিত হয় পুনর্বিন্যাসকৃত


সিলেবাস অনুযায়ী। অনিয়মিত শিক্ষার্থীদের জন্য নির্দেশনা: ২০২৬ সালের এসএসসি পরীক্ষায় অনিয়মিত ও জিপিএ

উন্নয়ন পরীক্ষার্থীদের জন্য নতুন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ২০২৫ সালের এক থেকে চার বিষয়ে ফেল করা পরীক্ষার্থীরা রেজিস্ট্রেশনের মেয়াদ থাকা সাপেক্ষে ২০২৬ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন। এজন্য শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান বরাবর সাদা কাগজে আবেদন করতে হবে আগামী ৩ ডিসেম্বরের মধ্যে। ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের এক বিজ্ঞপ্তিতে অনিয়মিত পরীক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, ২০২২-২৩ এবং ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে রেজিস্ট্রেশনধারী শিক্ষার্থী যারা ২০২৪ ও ২০২৫ সালে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেনি, স্ব স্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তারা অনিয়মিত পরীক্ষার্থী হিসেবে ২০২৬ সালে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবে। তাদের কোনো অবস্থাতেই নিয়মিত পরীক্ষার্থী হিসেবে গণ্য করা যাবে না। তারা ২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষার পূর্ণাঙ্গ সিলেবাসে প্রণীত প্রশ্নপত্রে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে। ২০২১-২০২২ সালে রেজিস্ট্রেশনধারী শিক্ষার্থীরা যাদের রেজিস্ট্রেশনের মেয়াদ শেষ অথচ চতুর্থ বিষয় বাদে এখনো এক বিষয়ে অকৃতকার্য আছে, সেসব শিক্ষার্থী বিশেষ বিবেচনায় রেজিস্ট্রেশনের মেয়াদ কেবল এক বছরের জন্য নবায়ন করে ২০২৬ সালের এসএসসি পরীক্ষায় অনিয়মিত পরীক্ষার্থী হিসেবে অকৃতকার্য বিষয়ে অংশগ্রহণ করতে পারবে। তাদের ২০২৫ সালের সিলেবাস (পুরাতন) অনুযায়ী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হবে। এসব পরীক্ষার্থীর আগে উত্তীর্ণ বিষয়/বিষয়গুলোর প্রাপ্ত জিপি সংরক্ষিত থাকবে। ২০২৬ সালের পরীক্ষায় তাদের অংশগ্রহণকৃত বিষয়ের জিপিএ আগে উত্তীর্ণ বিষয়/বিষয়গুলোর সংরক্ষিত জিপিএর সঙ্গে যোগ করে তাদের জিপিএ নির্ধারণ করা হবে।


কেবল ২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষায় সব বিষয়ে অংশগ্রহণ করে উত্তীর্ণ হয়েছে এবং জিপিএ-৫-এর কম পেয়েছে, এমন পরীক্ষার্থীরা রেজিস্ট্রেশনের মেয়াদ থাকলে ২০২৬ সালের পরীক্ষায় জিপিএ উন্নয়নের জন্য অংশগ্রহণ করতে পারবে এবং তাদের সব বিষয়ে ২০২৫ সালের পূর্ণাঙ্গ সিলেবাসে (পুরাতন) পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হবে। ২০২৬-এর পরীক্ষায় প্রাপ্ত ফলাফলে জিপিএ উন্নয়ন হলে তা গ্রহণ করা হবে। অন্যথায় আগের জিপিএ বহাল থাকবে। ২০২৬ সালের এসএসসি পরীক্ষার সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে প্রণীত প্রশ্নপত্রে নিয়মিত পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে। ২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষার পূর্ণাঙ্গ সিলেবাসে প্রণীত প্রশ্নপত্রে অনিয়মিত ও জিপিএ উন্নয়ন পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে।



  • সম্পাদক ও প্রকাশক: ইঞ্জিনিয়ার মো: রায়হানুল ইসলাম

  • উপদেষ্টাঃ মোঃ ইব্রাহীম হায়দার