ধ্বংসস্তূপ থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছি, আরএমপি এখন আরও শক্তিশালী: আরএমপি কমিশনার


স্টাফ রিপোর্টার : , আপডেট করা হয়েছে : 08-09-2025

ধ্বংসস্তূপ থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছি, আরএমপি এখন আরও শক্তিশালী: আরএমপি কমিশনার

এক বছর আগে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) ৩২তম কমিশনার হিসেবে যখন উপপুলিশ মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান দায়িত্ব নেন, তখন পরিস্থিতি ছিল একেবারেই ভিন্ন। গত বছরের জুলাই-আগস্টের সহিংসতায় ক্ষতবিক্ষত অবকাঠামো, সদস্যদের হারানো মনোবল এবং নগরবাসীর মনে জমে থাকা অবিশ্বাস ও ভয়—এই সবকিছুকে সঙ্গী করেই তাঁকে যাত্রা শুরু করতে হয়েছিল। দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর পূর্তিতে তিনি জানালেন সেই কঠিন পথ পাড়ি দেওয়ার কথা। তাঁর মতে, আরএমপি সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে কেবল ঘুরে দাঁড়ায়নি, বরং পোড়া ক্ষতকে শক্তিতে রূপান্তর করেছে।

বর্ষপূর্তি উপলক্ষে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি রাজশাহী মহানগরীর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং পুলিশ ও জনগণের সম্পর্ক নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন।

সেই সংকট এবং ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প:- গত বছরের অস্থিরতার কথা উল্লেখ করে কমিশনার মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান বলেন, "চব্বিশের জুলাই বিপ্লবের পরবর্তী নজিরবিহীন সহিংসতা আমাদের অবকাঠামো ও মনোবল—উভয় ক্ষেত্রেই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। আরএমপির ৮টি প্রধান স্থাপনা অকার্যকর হয়ে পড়েছিল, বহু যানবাহন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কিন্তু আমি গর্বের সাথে বলতে চাই, রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে আরও শক্তিশালী হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে।"

তিনি জানান, ক্ষতিগ্রস্ত সব স্থাপনা এখন সম্পূর্ণ কার্যকর। পোড়া যানবাহনের একটি বড় অংশকে মেরামত করে আবারও রাজপথে নামানো হয়েছে। সবচেয়ে বড় সাফল্য হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন লুট হওয়া অস্ত্রের বড় অংশ উদ্ধারের ঘটনাকে। তিনি বলেন, "আমাদের ১৬৪টি অস্ত্র লুট হয়েছিল, যার মধ্যে ১৪৭টি আমরা উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি। এটি আমাদের বাহিনীর দৃঢ়তা ও পেশাদারিত্বের প্রমাণ। এই সংকটকালীন সময়েও আমাদের অপরাধ দমন অভিযান, মাদক উদ্ধার এবং নাগরিক সেবা এক দিনের জন্যও থেমে থাকেনি।"

তবে আত্মতুষ্টিতে না ভুগে তিনি লুট হওয়া বাকি অস্ত্রগুলো নিয়ে তাঁর উদ্বেগের কথা জানান। দৃঢ়তার সাথে তিনি বলেন, "আমি নগরবাসীকে আশ্বস্ত করতে চাই, লুট হওয়া বাকি ১৭টি অস্ত্র উদ্ধার করা আমাদের জন্য সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার এবং একটি বড় চ্যালেঞ্জ। প্রতিটি অস্ত্র উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত আমাদের অভিযান চলবে। জনগণের নিরাপত্তা নিয়ে আমরা বিন্দুমাত্র ছাড় দেব না।"


বর্তমান আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা:- কমিশনারের মতে, রাজশাহী মহানগরীর বর্তমান আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে স্থিতিশীল রয়েছে। তিনি বলেন, "যোগদানের পর আমার প্রথম এবং প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল পুলিশের মনোবল ফিরিয়ে এনে মহানগরীর আইন-শৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখা। সকলের সহযোগিতায় আমরা তা দ্রুততম সময়ে করতে পেরেছি। সম্প্রতি হিমাগারে ডাকাতির মতো চাঞ্চল্যকর ঘটনাতেও আমরা অপরাধীদের দ্রুততম সময়ে শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছি। এছাড়াও রাজশাহীতে জুলাই আন্দোলনে হামলার ঘটনায় দায়ের করা দুটি হত্যাসহ মোট ৯টি মামলার চার্জশিট দেয়া হয়েছে।"

তবে সড়কের শৃঙ্খলা ফেরানো এবং যানজট নিরসনকে তিনি অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে স্বীকার করে বলেন, এ বিষয়গুলোতে আরও অনেক কাজ করার সুযোগ রয়েছে।

ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি একটি প্রযুক্তিনির্ভর, জনবান্ধব ও টেকসই নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলেন। তাঁর চতুর্মুখী কর্মপরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে:

গোয়েন্দা তথ্যভিত্তিক অভিযান: মাদক, চোরাচালান এবং সংগঠিত অপরাধ দমনে 'জিরো টলারেন্স' নীতি অনুসরণ।

প্রযুক্তিগত নজরদারি: অপরাধী শনাক্তকরণ ও অপরাধ প্রমাণ সহজ করতে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো সিসি ক্যামেরা এবং সোশ্যাল মিডিয়া প্রেট্রোলিং এর আওতায় আনা।

জনমুখী পুলিশিং: বিট পুলিশিং কার্যক্রমকে আরও শক্তিশালী করে পুলিশের সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া।

সাইবার সক্ষমতা বৃদ্ধি: ক্রমবর্ধমান সাইবার অপরাধ মোকাবেলায় আরএমপির বিশেষায়িত টিমকে আরও দক্ষ ও আধুনিক সরঞ্জাম দিয়ে সজ্জিত করা।

নগরবাসীর প্রতি আহ্বান ও প্রত্যাশা:- জনসম্পৃক্ততা ছাড়া পুলিশের একার পক্ষে অপরাধ দমন সম্ভব নয় বলে মনে করেন আবু সুফিয়ান। তিনি বলেন, "আমরা চাই, পুলিশ শুধু আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হিসেবে নয়, জনগণের বন্ধু হিসেবে কাজ করবে। যেকোনো নাগরিক যেন নির্ভয়ে থানায় এসে তার অভিযোগ জানাতে পারে, সেই পরিবেশ আমরা নিশ্চিত করতে চাই।"

নগরবাসীর কাছে তাঁর প্রত্যাশা, তারা যেন আইন মেনে চলেন এবং পুলিশকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেন। তিনি বলেন, "যেকোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড, সন্দেহভাজন ব্যক্তির আনাগোনা চোখে পড়লে সাথে সাথে পুলিশকে জানান। আপনার দেওয়া একটি সঠিক তথ্য বড় ধরনের অপরাধ প্রতিরোধ করতে পারে।"

বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো এবং হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার নিয়ে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন। পাশাপাশি, অপরিকল্পিতভাবে বেড়ে ওঠা অটোরিকশার কারণে সৃষ্ট যানজট নিরসনেও তিনি নগরবাসীর সম্মিলিত সহযোগিতা কামনা করেন।

সবশেষে নগরবাসীকে আশ্বস্ত করে তিনি বলেন, "আপনাদের নিরাপত্তা বিধানে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ সর্বদা আপনাদের পাশে আছে। আসুন, আমরা সবাই মিলে আইন মেনে চলি এবং একটি সুন্দর, নিরাপদ ও শান্তিময় রাজশাহী গড়ে তুলি।"


  • সম্পাদক ও প্রকাশক: ইঞ্জিনিয়ার মো: রায়হানুল ইসলাম

  • উপদেষ্টাঃ মোঃ ইব্রাহীম হায়দার