সূর্যমুখী তেল বহুকাল ধরেই সাধারণ ও সহজলভ্য ভেজিটেবল অয়েল হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এটি মাখন বা স্যাচুরেটেড ফ্যাটের চেয়ে স্বাস্থ্যকর বলে মনে করা হতো। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর প্রকৃত স্বাস্থ্যগত অবদান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, বিশেষ করে যখন তেলটি বারবার ভাজার জন্য বা উচ্চ তাপমাত্রায় রান্নায় ব্যবহার করা হয়।
তাই রান্নার জন্য এই তেল বেছে নেওয়ার আগে যেসব বিষয় জানা জরুরি-
১. উচ্চ ওমেগা-৬ সমৃদ্ধ তেল
সূর্যমুখী তেলে ওমেগা-৬ ফ্যাটি অ্যাসিড, বিশেষ করে লিনোলিক অ্যাসিডের পরিমাণ খুব বেশি। ওমেগা-৬ একটি অপরিহার্য ফ্যাটি অ্যাসিড এবং আমাদের শরীর নিজে এটি তৈরি করতে পারে না। রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা, ত্বক ও মস্তিষ্কের সঠিক কার্যকারিতার জন্য ওমেগা-৬ নির্দিষ্ট পরিমাণে প্রয়োজন।
সমস্যা তখনই শুরু হয় যখন ওমেগা-৩ এর তুলনায় ওমেগা-৬ বেশি হয়ে যায়, যা আধুনিক পশ্চিমা খাদ্যাভ্যাসে সাধারণ ঘটনা। এই দুই অ্যাসিডের অনুপাতের ভারসাম্য নষ্ট হলে শরীরে প্রদাহজনিত প্রক্রিয়া বাড়তে পারে, যা গবেষণায় হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, স্থূলতা এমনকি অটোইমিউন রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত।
সাধারণ সূর্যমুখী তেলে ওমেগা-৬ এর পরিমাণ ৭০% এর বেশি হতে পারে, যা বিশেষ করে নিয়মিত ভাজা বা রান্নায় ব্যবহারের ফলে ভারসাম্যহীনতা তৈরি করে।
২. ভাজলে সূর্যমুখী তেলের পুষ্টিগুণ দ্রুত পরিবর্তন হয়
সূর্যমুখী তেলের অন্যতম বড় সমস্যা হল উচ্চ তাপে এর অস্থিতিশীলতা। দ্রুত গরম হয়ে যাওয়া তেল সহজে অক্সিডাইজ হয় এবং ক্ষতিকর পদার্থ তৈরি করে, যার মধ্যে ফ্রি র্যাডিক্যালও রয়েছে যা শরীরের কোষ ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
বারবার ভাজা বা দীর্ঘ সময় ধরে রান্নায় ব্যবহার করলে সূর্যমুখী তেল অক্সিডেশন ও ভাঙনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর যৌগ তৈরি করতে পারে; বিশেষ করে যদি তেলটি আগে থেকেই তৈরি করার সময় গরম করা হয়ে থাকে বা দীর্ঘদিন আলো ও তাপে সংরক্ষিত থাকে।
৩. উপকারী উপাদানে কম সমৃদ্ধ
অলিভ অয়েলের মতো প্রাকৃতিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট (যেমন পলিফেনল ও ভিটামিন ই) সূর্যমুখী তেলে তেমন থাকে না। যদি কৃত্রিমভাবে সমৃদ্ধ না করা হয়, তবে সাধারণ সূর্যমুখী তেলে ভিটামিন ই-এর পরিমাণ খুব কম। আর কখনো কখনো একেবারেই থাকে না, ফলে অক্সিডেটিভ ক্ষতি থেকে শরীরের কোষকে সুরক্ষিত রাখার ক্ষমতা কম।
৪. অতিরিক্ত ক্যালরি যোগ করে
যেকোনো তেলের মতো সূর্যমুখী তেলও উচ্চ ক্যালরি-সমৃদ্ধ। এক টেবিলচামচে প্রায় ১০০ ক্যালরি থাকে, যা সহজেই ভাজা, স্টার ফ্রাই বা সালাদে যোগ হয়। পরিমাণে সতর্ক না হলে রান্না ও সালাদে অবাধে তেল ব্যবহার করা ওজন বৃদ্ধি ও শরীরে ভারি ভারি লাগার অনুভূতি আনতে পারে।
৫. কারখানায় প্রক্রিয়াজাত ও পরিশোধিত
সস্তা সূর্যমুখী তেল, যা বড় বোতলে সুপারমার্কেটে মেলে, সাধারণত কারখানায় পরিশোধিত হয়। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে গরম করা, ফিল্টার করা ও রাসায়নিক ব্যবহার করা ইত্যাদি। এসব প্রক্রিয়ায় এর পুষ্টিমান আরও কমে যায়, সক্রিয় উপাদান নষ্ট হয় এবং কখনো কখনো এমন যৌগের সামান্য পরিমাণ থেকে যায় যা দীর্ঘমেয়াদে বেশি গ্রহণ করলে ক্ষতিকর হতে পারে।
কোল্ড-প্রেসড সূর্যমুখী তেলের কী অবস্থা?
কোল্ড-প্রেসড সূর্যমুখী তেল তুলনামূলকভাবে কিছুটা ভালো বিকল্প। কারণ, এ প্রক্রিয়ায় কিছু ভিটামিন ‘ই’ বজায় থাকে এবং উৎপাদনের সময় তেল তাৎক্ষণিক অক্সিডেশন থেকে রক্ষা পায়।
এটি পুষ্টিগতভাবে কিছুটা ভালো হলেও কোল্ড-প্রেসিংয়ের পরও তেলের গঠন ওমেগা-৬ এ সমৃদ্ধ থাকে, যা ওমেগা-৩ এর ভারসাম্য ঠিক করে না। এছাড়া এ ধরনের তেল সাধারণত রান্না বা ভাজার জন্য উপযুক্ত নয় বরং ঠান্ডা খাবারে— যেমন সালাদে ব্যবহারের জন্য ভালো।
সূর্যমুখী তেল আসলে শরীরের জন্য ক্ষতিকর নয়, তবে এটি দৈনন্দিন ব্যবহার বা উচ্চ তাপে রান্নার জন্য সবচেয়ে ভালো বিকল্প নয়।
যারা শরীরের মেদ কমাতে, হৃদ্স্বাস্থ্য উন্নত করতে এবং ক্ষতিকর যৌগ এড়াতে চান, তারা রান্নার জন্য বেশি স্থিতিশীল তেল— যেমন এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল, অ্যাভোকাডো অয়েল বা নারকেল তেল বেছে নিতে পারেন। সূর্যমুখী তেল ব্যবহার করলেও তা সীমিত ও মাঝে মাঝে ব্যবহার করা উচিত।
সবসময় মনে রাখতে হবে— কোন তেল ব্যবহার করা হচ্ছে সেটা মুখ্য নয় বরং কতটা এবং কীভাবে ব্যবহার করছেন সেটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
তথ্যসূত্র: জেরুজালেম পোস্ট