১৯৩০ সালের অ্যাশেজের শেষ টেস্টে ডন ব্র্যাডম্যান আউট হলে লন্ডনের ইভনিং পত্রিকা দ্য স্টার শিরোনাম করেছিল ‘হি’জ আউট’। ইংল্যান্ডের স্বস্তি ছিল তখন চোখে পড়ার মতো। একশ বছর পর লর্ডসে শুবমান গিল আউট হওয়ার পর ক্রিস ওকসের মুখেও দেখা গেল একইরকম স্বস্তি।
গিল যখন ইংল্যান্ডে আসেন, তখন তার গড় ছিল ৩৫। প্রমাণ করার মতো অনেক কিছু ছিল তার। কিন্তু এজবাস্টনে ৪৩০ রানের ঐতিহাসিক ম্যাচ খেলার পর থেকেই তার নাম উচ্চারিত হচ্ছে ব্র্যাডম্যানের পাশে। এই সিরিজের প্রথম দুই টেস্টেই গিল করেছেন ৫৮৫ রান। পাঁচ ম্যাচের সিরিজে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডটা ব্র্যাডম্যানের, ৯৭৪ রান করেছিলেন তিনি ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। সে রেকর্ড গিল ছুঁতে পারেন—এমন আশঙ্কা দেখা দিচ্ছিল ইংল্যান্ড শিবিরে।
এজবাস্টনে দুই ইনিংসেই আউট হলেও সেটা ক্লান্তি ও মানসিক চাপের ফল, ইংলিশদের কৌশলের ফলে নয়। এমন এক টেস্ট শেষে নতুন লড়াইয়ের শুরুতে বেন স্টোকস জানাননি তারা কী পরিকল্পনা করেছেন গিলকে নিয়ে, শুধু বলেছিলেন, ‘আমাদের সবার জন্য পরিকল্পনা আছে।’
তবে বাস্তবে ইংল্যান্ড বুঝিয়ে দিল, গিলের জন্য আলাদা প্রস্তুতি ছিল। জফরা আর্চারকে ৪ বছর পর টেস্টে ফেরানোর সিদ্ধান্তটা নেওয়া হয়েছিল গিলের দাপট ঠেকাতেই। ফিরেই আর্চার নজর কেড়েছেন, এ সিরিজের সবচেয়ে দ্রুত গতির বল ছুঁড়েছেন প্রথম চার বলেই।
গিল যখন নামলেন চার নম্বরে, আর্চারও ফিরলেন দ্বিতীয় স্পেলে। প্রথম বলেই ৮৮ মাইল গতির শর্ট বল ছুঁড়ে গিলকে পেছনে ঠেলে দিলেন। গিলের বিপক্ষে আর্চারের রেকর্ডটা দারুণ: টেস্টে ২৮ বলে দুইবার আউট, আইপিএলে ১৯ বলে তিনবার আউট। সে ম্যাচআপটাকেই কাজে লাগাতে চেয়েছিল ইংল্যান্ড।
বল নরম হতে শুরু করতেই স্টোকস চালালেন পরিচিত শর্ট বল কৌশল। আর্চারের জন্য সাজালেন ছয়জন লেগ-সাইড ফিল্ডার: লং লেগ, ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ার লেগ, ডিপ স্কয়ার লেগ, স্কয়ার লেগ, ফরোয়ার্ড স্কয়ার লেগ ও মিড উইকেট। কিন্তু গিল তেমন বিপদে পড়লেন না, বরং শর্ট বল ড্রাইভ করলেন কভার দিয়ে।
তখনই স্টোকস আনলেন আরেক চাল। গিল ক্রিজে আসার সঙ্গে সঙ্গে হেলমেট পরে এলেন উইকেটরক্ষক জেমি স্মিথ। ওকস বোলিং শুরু করতেই স্মিথ দাঁড়িয়ে গেলেন স্টাম্পে। গিলও স্টাম্পড হওয়ার ভয়ে খেলতে চাইলেন একটু ভেতর থেকে। গিল প্রথম বলেই লেগ-সাইডে ঠেলে এক রান নিয়ে স্ট্রাইক ছেড়ে দিলে স্মিথ পেছনে চলে যান।
কাজটা ইংল্যান্ড করেছে লর্ডসের বিখ্যাত ‘ঢাল’ বা স্লোপকে কাজে লাগাতে। প্যাভিলিয়ন এন্ড থেকে শুরু করে নার্সারি এন্ড পর্যন্ত তির্যকভাবে ঢালু লর্ডসের এই মাঠ। ১৮১৪ সালে যখন মাঠটা তৈরি হয়েছিল, তখন থেকেই এই ঢালটা আছে। এরপর আধুনিক যুগে এই ঢালটা সমান করার আলাপ বহুবার উঠেছে বটে, কিন্তু ইতিহাসকে সম্মান জানিয়ে, সঙ্গে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার কথা মাথায় রেখে তা আর বাস্তবায়ন করা হয়নি।
এই ঢাল ব্যাটারদের জন্য বিপদ তৈরি করে, বোলারদের দেয় বাড়তি সুবিধা। নার্সারি এন্ড থেকে বলগুলো ডানহাতি ব্যাটারদের জন্য বাইরে বেরিয়ে যায়, আর বাঁহাতিদের জন্য আসে ভেতরে; প্যাভিলিয়ন এন্ড থেকে আবার উল্টোটা ঘটে। বলের লেন্থ যত বেশি হবে, বলটা গতিপথ বদলে ব্যাটারকে বিপদে ফেলার সম্ভাবনা বাড়বে ততই।
জো রুটও পরে স্বীকার করেছেন বিষয়টা, ‘এই মাঠে পেছনে দাঁড়িয়ে খেললে বলের গতিপথ পরিবর্তনের সুযোগ বেশি থাকে। এতে আউটের সম্ভাবনা বাড়ে।’
এজবাস্টনে গিল ক্রিজের অনেক বাইরে দাঁড়িয়ে খেলতেন। তখন ওকসকে মাঝারি গতির বোলার মনে হচ্ছিল। তখন ১৫৩ বলে ১০২ রান করেছিলেন ওকসের বিপক্ষে, আউট হননি একবারও। কিন্তু লর্ডসে স্মিথ কাছে দাঁড়ানোয় গিল বাধ্য হন পেছনে যেতে। এতে বলের গতিপথ পাল্টে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।
তিন বল পরই ওকস একটি ভুল শট বের করিয়ে আনেন। গিল এগিয়ে এসে খেলেন, বল ব্যাটের কানায় লেগে চলে যায় সেকেন্ড স্লিপের পাশ দিয়ে, ভাগ্যগুণে তিনি পেয়ে যান চার রান। কিছুক্ষণ পর স্ট্রেট ড্রাইভে চমৎকার চার মারেন তিনি। কিন্তু যখন ওকস ক্রিজে একটু বাইরে গিয়ে বল করেন, গিলের ব্যাটের বাইরের কানায় লেগে বল যায় উইকেটরক্ষকের কাছে। স্মিথ কঠিন ক্যাচটা নেন দারুণভাবে।
গিল ১৬ রান করে আউট হন। এই সিরিজে দ্বিতীয়বার তিনি আউট হলেন ৫০ রানের আগে।
রেকর্ডের সুযোগ অবশ্য এখনও শেষ হয়ে যায়নি। এখনো হাতে পাঁচ ইনিংস আছে। যদি তিনি আরও ৩৭৩ রান করতে পারেন, তাহলে ব্র্যাডম্যানের রেকর্ড ছাপিয়ে যাবেন।
তবে ইংল্যান্ড এখন একটু স্বস্তিতে, কারণ এজবাস্টনের বাউন্ডারি-বন্যার পর অন্তত একবার তো গিলকে থামানো গেল।