১২ ফুট রাস্তা থাকলে পাঁচ কাঠার প্লটে করা যাবে ৮ তলা ভবন


, আপডেট করা হয়েছে : 13-09-2023

১২ ফুট রাস্তা থাকলে পাঁচ কাঠার প্লটে করা যাবে ৮ তলা ভবন

আবাসন খাত ও ভূমি ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে অবশেষে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) সংশোধন করল সরকার। সংশোধিত ড্যাপে এরই মধ্যে অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এখন বাকি শুধু তা গেজেট আকারে প্রকাশ করা।


সংশোধিত ড্যাপে ভবন নির্মাণে বেশ কিছু ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে পরিবর্তন আনা হয়েছে, তা হলো ফ্লোর এরিয়া রেশিও (ফার) পুনর্বিন্যাস। ফার বৃদ্ধির ফলে আগের চেয়ে ভবনের উচ্চতা ও প্রশস্ততা বাড়াতে পারবেন জমির মালিক।


জানতে চাইলে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী মো. শরীফ আহমেদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ড্যাপ নিয়ে বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে কথা বলে তা সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। ফার কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। আশা করছি, ভবন নির্মাণে উচ্চতার প্রশ্নে যে আপত্তি ছিল, তা আর থাকবে না। সংশোধিত ড্যাপ এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন করেছেন। এখন কিছু দাপ্তরিক কাজকর্ম চলছে। খুব দ্রুত তা গেজেট আকারে প্রকাশ করা যাবে।’


সংশোধিত ড্যাপে তিনটি ক্যাটাগরি করে ছাড়গুলো দিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। ক্যাটাগরিগুলো হলো পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা, অপরিকল্পিত আবাসিক এলাকা ও ব্লকভিত্তিক উন্নয়ন।


অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা এলাকায় (যেমন বাড্ডা, ডেমরা, রায়েরবাজার, খিলক্ষেত ও দক্ষিণখান) ৫ কাঠা আয়তনের একজন ভূমিমালিক বর্তমানে কমপক্ষে ১৬ ফুট প্রশস্ত রাস্তা থাকলে ৬ তলা উচ্চতার ভবন করতে পারেন। সংশোধিত ড্যাপে যেভাবে ফার বাড়ানো হয়েছে, তাতে ১২ ফুট রাস্তা হলেই ৮ তলা ভবন করতে পারবেন তাঁরা। 


বিদ্যমান ড্যাপ অনুযায়ী উত্তরা, মিরপুর, ধানমন্ডি, বসুন্ধরা ও বনশ্রীর মতো পরিকল্পিত আবাসিক এলাকাগুলোয় যেখানে সর্বনিম্ন রাস্তা ২৫ ফুট আছে; সেখানে ৫ কাঠা আয়তনের প্লটে ৯ তলা উচ্চতার ভবন নির্মাণ করা যায়। সংশোধিত ড্যাপে ভবনের উচ্চতা বাড়িয়ে ১০ তলা পর্যন্ত করার সুযোগ রাখা হয়েছে। আর যদি রাস্তা ৬০ ফুট হয়, সে ক্ষেত্রে ১২ তলা পর্যন্ত নকশা অনুমোদন পাবেন ভূমির মালিক।


একইভাবে ব্লকভিত্তিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ১ বিঘা থেকে ৬ বিঘা পর্যন্ত আয়তনের ব্লকে ২০ শতাংশ, আর ১৫ বিঘার বেশি আয়তনের ব্লকে ৩০ শতাংশ প্রণোদনা পাবেন ভূমিমালিক। এতে আগের তুলনায় নতুন ভবনের উচ্চতা বা প্রশস্ততা বাড়বে।


ব্লকভিত্তিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে আরও কিছু বিষয় রাখা হয়েছে সংশোধিত ড্যাপে। যেমন ব্লকের মোট জমির ৪০ শতাংশ অংশ উন্মুক্ত স্থান (পার্ক, খেলার মাঠ, সবুজ ভূমি) হিসেবে সংরক্ষণ করতে হবে। সংরক্ষিত জমির কমপক্ষে ৫০ শতাংশ একত্রে থাকতে হবে। এ ছাড়া ব্লকের মোট আয়তনের ৮০ শতাংশ জমির ওপর সর্বোচ্চ ভূমি আচ্ছাদন হিসাব করতে হবে। 


রাজউকের নগর-পরিকল্পনাবিদ ও ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ড্যাপ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা বিভ্রান্তি যে, তা হলো ভবনের উচ্চতা। এখানে অপরিকল্পিত এলাকা আর পরিকল্পিত এলাকার রাস্তার প্রশস্ততার কারণে ভবনের ফার কম-বেশি হয়েছে। এখন ক্যাটাগরি অনুযায়ী সংশোধনী ড্যাপে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। সেখানে ফার বাড়বে। কোনো ভূমিমালিক চাইলে তা ভবনের উচ্চতা ও প্রশস্ততা যেকোনো দিকে বাড়িয়ে নিতে পারবেন।’


ফার কী পরিমাণে বেড়েছে, এমন এক প্রশ্নে এ কর্মকর্তা বলেন, ‘যে প্লট-সংলগ্ন ২৫ ফুট রাস্তা আছে, সেখানে ৫ কাঠা আয়তনের জমি হলে আগের ফারের সঙ্গে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। সেই হিসেবে প্লট-মালিক নতুন করে ১৮০০ বর্গফুট বাড়িয়ে নিতে পারবেন। জমির পরিমাণ ৬ থেকে ১০ কাঠা হলে আরও শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ ফার বেশি পাবে। সেই হিসেবে আরও ৯০০ বর্গফুট যোগ হবে। আবার ১০ কাঠা থেকে তদূর্ধ্ব পর্যন্ত শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ ফার যোগ হবে। সেখানে ভূমিমালিক ফার পাবেন ১৮০০ বর্গফুট। এ ফার ভবনমালিক উচ্চতা বা পাশে বাড়িয়ে নিতে পারবেন। এমনিভাবে অপরিকল্পিত এলাকায়ও ভূমিমালিকেরা শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ ফার প্রণোদনা পাবেন। তবে প্লট-সংলগ্ন রাস্তা কমপক্ষে ১২ ফুট হতে হবে। ১ বিঘার ওপরে যেসব প্লট রয়েছে, সেগুলো ব্লক উন্নয়ন ক্যাটাগরিতে পড়বে। আর তাঁরা ফার বেশি পাবেন।’ 


ড্যাপে আনা এসব সংশোধনীর বিষয়ে জানতে চাইলে স্থপতি ইকবাল হাবিব আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ড্যাপ সংশোধনী নিয়ে নগরবিদদের পক্ষ থেকে ৮ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমাদের এসব নির্দেশনা আমলে না নিয়ে রিহ্যাব এবং ভূমি ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে যেসব প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে, সেগুলো আমলে নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। রাজউক এবং মন্ত্রণালয় মিলে কারসাজির মাধ্যমে ভূমি ব্যবসায়ীদের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছে, এটা একেবারেই দৃশ্যমান। এই সংশোধনী সাধারণ মানুষের কোনো কাজে আসবে না। এখানে নিম্নাঞ্চলসহ জীববৈচিত্র্যকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। আমরা এ ধরনের সংশোধনী প্রত্যাখ্যান করি এবং সরকারের উচ্চপর্যায়ে তদন্তের মাধ্যমে যারা এ কাজ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানাই। এটি বাস্তবায়িত হলে মূলত ঢাকা ভূমি ব্যবসায়ীদের শহরে পরিণত হবে।’


তবে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দাবি, বিভিন্ন মহল ও সাধারণ মানুষের আপত্তির কারণে ড্যাপ সংশোধন করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় সূত্র বলেছে, ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে ড্যাপের গেজেট প্রকাশিত হওয়ার পর নানা আপত্তি তুলে আসছিল বিভিন্ন মহল ও সাধারণ মানুষ; বিশেষ করে ফার ও জনঘনত্ব জোনিংয়ের বিষয়ে এ আপত্তি তীব্র হয়। একপর্যায়ে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) ও বাংলাদেশ ল্যান্ড ডেভেলপার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলডিএ) আবেদনের পর তা আমলে নেয় সরকার। এ মহাপরিকল্পনা সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রণোদনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।


ড্যাপ নিয়ে আপত্তির বিষয়ে জানতে চাইলে রিহ্যাবের প্রেসিডেন্ট আলমগীর শামসুল আলামিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘পরিকল্পিত নগরায়ণ মানে কোথাও কনস্ট্রাকশন করা যাবে না; বিষয়টি এ রকম নয়। বর্তমান ড্যাপে আবাসন ব্যবসায়ীদের ওপর অবিচার করা হয়েছিল। আমরা সরকারের বিভিন্ন স্তরে এ বিষয়ে আবেদন-নিবেদন করেছি। এখন সরকার যে ধরনের প্রণোদনা ঘোষণা করতে যাচ্ছে, আমরা মনে করি, এটি বাস্তবসম্মত। এটি বাস্তবায়িত হলে আবাসন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত শত শত শিল্পপ্রতিষ্ঠানও উপকৃত হবে।’


ঢাকার সমস্যাগুলো কমিয়ে পরিকল্পিত নগর গড়ার জন্য ১৯৯৬ সালে ড্যাপ প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরপর অনেক জল ঘোলা হয়েছে। পার হয় দুই যুগের বেশি সময়। এই সময়ে দফায় দফায় রূপ বদলায় এই পরিকল্পনা। অনেক আলোচনা, বিতর্ক ও সমালোচনার মুখে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ড্যাপ অনুমোদন করে মন্ত্রিসভা কমিটি। অবেশেষে গত বছরের আগস্টে গেজেট আকারে প্রকাশ পায় ড্যাপ। কিন্তু গেজেট হওয়ার পরপরই বিভিন্ন মহলে এ নিয়ে বেশ হইচই পড়ে যায়, বিশেষ করে আবাসন খাতের ব্যবসায়ী এবং ভোক্তারা ড্যাপের ফ্লোর এরিয়া রেশিও (ফার) নিয়ে চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তাঁরা ফার বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছিলেন। তাঁদের দাবির মুখে অবশেষে আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছে রাজউক। সংশোধন করা হয়েছে ড্যাপ। 


এ বিষয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্তসচিব কাজী ওয়াসি উদ্দিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সংশোধিত ড্যাপে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর আমরা তা আইন মন্ত্রণালয়ে ভ্যাটিংয়ে পাঠিয়েছিলাম; সেখান থেকে সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে এসেছে। চূড়ান্ত পর্যালোচনা শেষে খুব দ্রুত গেজেট আকারে প্রকাশ করব।’



  • সম্পাদক ও প্রকাশক: ইঞ্জিনিয়ার মো: রায়হানুল ইসলাম

  • উপদেষ্টাঃ মোঃ ইব্রাহীম হায়দার